হাসপাতালগুলোতে গরমের পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা

বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
 চলমান তাপপ্রবাহে ওষ্ঠাগত জনজীবন।  দেশের বেশির ভাগ এলাকায় অসহনীয় গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। যতই দিন যাচ্ছে আবহাওয়া ততই বিরূপ ও চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। দিনভর প্রখর রোদ। খাঁ খাঁ করছে পথঘাট। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গরমের অসহনীয় তীব্রতা। ঘরে কিংবা বাইরে স্বস্তিতে নেই মানুষ।  থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম।  গরমের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগবালাই। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীর লাইন ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে।
ডায়রিয়া রোগের অন্যতম চিকিৎসা কেন্দ্র রাজধানীর মহাখালির আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) বা কলেরা হাসপাতাল ভিড় করছেন স্বজনেরা। প্রতিদিন গড়ে ৫’শ বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে ভর্তি হচ্ছেন।  একই অবস্থা বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল   এবং  মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী বহিঃ ও জরুরি বিভাগে  চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলছেন, গ্রীষ্মের খরতাপে হাসপাতাগুলোতে ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, ঠাণ্ডা, জ্বর-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ,জন্ডিস, হিট স্ট্রোকসহ নানা সমস্যা নিয়ে বেশিরভাগই রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর তীব্র গরমের কারণে সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুরা। আবার তীব্র তাপদাহে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ছে। হিটস্ট্রোকসহ নানা সমস্যা থেকে রেহাই পেতে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
কলেরা হাসপাতালের পরিসংখান অনুযায়ী, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত  গত  ১৬ দিনে মোট ৭ হাজার ৪২৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ  প্রতিদিনে গড়ে প্রায় ৫’শ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে গত ৭ এপ্রিল ৪৬১ জন, ৮ এপ্রিল ৪৬৯ জন, ৯ এপ্রিল ৪১৪ জন, ১০ এপ্রিল ৪২৯ জন, ১১ এপ্রিল ৪৪৯ জন, ১২ এপ্রিল ৫৯৫ জন, ১৩ এপ্রিল ৫২৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৪৩৪ জন, ১৫ এপ্রিল ৪৯১ জন,  ১৬ এপ্রিল ৪৭৪ জন, ১৭ এপ্রিল ৪৩২ জন ১৮ এপ্রিল, ৪৪৫  জন, ১৯ এপ্রিল ৪৫৬ জন, ২০ এপ্রিল ৫৪৩ জন, ২১ এপ্রিল ৫২২ জন এবং ২২ এপ্রিল সোমবার বেলা তিনটা পর্যন্ত মোট ২৮৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
সোমবার সরেজমিনে কলেরা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে স্বজনদের ভিড়। একজন রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি স্বজন ঢুকতে দেয় না প্রতিষ্ঠানটি। জরুরি বিভাগে রোগীদের প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়া রোগী হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এরপর তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হচ্ছে আসলে রোগী কী ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। এরপর তাদের অবস্থা বিবেচনা করে স্যালাইন দেওয়া কিংবা ভর্তি করানো হচ্ছে। কিছু রোগীকে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠাতে দেখা গেছে।
আইসিডিডিআর,বির এসিটেন্ট সায়েন্টিস্ট শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, ডায়রিয়া মূলত   পানিবাহিত রোগ। দূষিত পানি পান করার মাধ্যমে এই রোগ হয়। সাধারণত দিনে কারও তিন বা তার চেয়ে বেশিবার পাতলা পায়খানা হলে তার ডায়রিয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বিশেষত মে-জুন ও নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এরই মধ্যে ডায়রিয়ায় প্রতিদিন গড়ে পাঁচশর মতো রোগী ভর্তি হচ্ছে।
কোন বয়সী রোগী বেশি ডায়রিয়ার সমস্যা নিয়ে আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে সব বয়সের মানুষই ভর্তি হচ্ছে। তবে এই সময়ে শিশুদের ডায়রিয়া বেশি হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। যেমন, বাইরের খোলা শরবত খাচ্ছে, সেখানে যে বরফ থাকে তাতে প্রচুর জীবাণু থাকতে পারে।
তিনি বলেন, ডায়রিয়ার চিকিৎসা খুবই সহজ। এক প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খাবেন। ৬ মাসের বেশি বয়সী রোগী ওরস্যালাইনের পাশাপাশি সব ধরনের স্বাভাবিক খাবার খাবে। এছাড়াও নিকটস্থ হাসপাতাল থেকে শুরু করে সব জায়গায় ডায়রিয়ার ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। আর গরমের এই সময়ে প্রচুর পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন, তরল ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর ও উন্মুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। আর  বাইরে বের হলে সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, গত কয়েকদিনের গরমে কারণে অন্যান্য বছরের ‍তুলনায় বর্তমানে  রোগী বেশি আসছে হাসপাতালে। তীব্র গরমে শিশুরা প্রচুর ঘামছে। এতে পানিশূন্যতা তৈরি হচ্ছে।  ডায়রিয়া, ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর ও নিউমোনিয়ার রোগী বেশি আসছে। ভর্তির প্রয়োজন আছে এমন শিশুর সংখ্যা ৫ শতাংশের মতো হবে। তবে ঈদের ছুটি কাটিয়ে এখনও অনেক মানুষ ঢাকায় ফেরেনি।
আর গরমের সময়ে শিশু ও বয়স্কদের ব্যাপারে বাড়তি সর্তকতার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই সময়ে প্রচুর পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন, তরল ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর ও উন্মুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। আর  বাইরে বের হলে সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মেডিসিন ডা. মো. আল আমিন বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে অসুস্থ রোগীর চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে হিট ইডিমা, হিট ক্র্যাম্প, হিট সিনকোপ, হিট এগজেশন ও হিট স্ট্রোক রোগী আসছে। হিট স্ট্রোকে বয়স্ক, শিশু, দীর্ঘ মেয়াদে রোগাক্রান্ত স্থুল ও শ্রমজীবীরা ঝুঁকিপূর্ণ। আগে বর্হিবিভাগে দৈনিক গড়ে ২ হাজার রোগী আসলেও এখন তিন হাজারের মত আসছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরেও তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে রোগী ও স্বজনরা।  নির্ধারিত শয্যার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী। এদের কেউ বেডে, কেউবা ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছে। উৎকণ্ঠিত বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন রোগীদের বিছানার পাশে বসে রোগমুক্তির প্রহর গুনছেন। সুস্থ হওয়ার তুলনায় আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতি মুহূর্তেই চাপ বাড়ছে হাসপাতালে। যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। তবে সাধ্যমতো রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ  বলেন,  এই হাসপাতালে সারাদেশ থেকেই রোগীরা আসে।  তীব্র গরমের  কারণে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুরা ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। রোগীর চাপ আগামী কয়েকদিনে আরও বাড়তে পারে। রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধ্যমত চেষ্টা করছেন বলে জানান এই শিশু চিকিৎসক।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com