হার্টের রিং নিয়ে রোগীদের ভোগান্তি, সমাধান কতদূর?

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
হার্টের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে স্টেন্ট বা রিং পরানো। কারও হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালনে ব্লক বা বাধার সৃষ্টি হলে ডাক্তার তাকে এক বা একাধিক রিং পরানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গত ১৬ ডিসেম্বর সরকার হার্টের রিংয়ের নতুন দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকে তা কার্যকর হয়েছে। তবে নতুন ওই দাম বৈষম্যমূলক, এমন অজুহাত তুলে আমদানিকারকরা হাসপাতালগুলোয় রিং সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। দাম কার্যকরের ১২ দিন পরও এই অচলাবস্থার অবসান হয়নি। আবার দাম নির্ধারণ কার্যকরের পর বিষয়টি গড়িয়েছে হাইকোর্টে। ফলে তিন কোম্পানির সীমিত আকারে হার্টের রিং বাজারে থাকলেও রোগীদের কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। কিন্তু রোগীর ব্লকের পরিমাপে মিলছে না রিং। ফলে রিংয়ের পরিমাপ জটিলতায় হাসপাতালগুলোয় অস্ত্রোপচার নেমে এসেছে অর্ধেকে। চলমান এ অচলাবস্থা নিরসনে গতকাল মঙ্গলবার ইউরোপীয় ২৪টি কোম্পানির প্রতিনিধি দল ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে বৈঠক করেছে। জানা গেছে, কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়েছে।

রিং ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা রিং সরবরাহ বন্ধ রাখবেন। তবে রোগী দুর্ভোগের কথা অস্বীকার করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।
চিকিৎসকরা জানান, রিং সমস্যার সমাধান না হলে সামনে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে। কারণ সরকারি হাসপাতালগুলোয় নিম্নআয়ের মানুষরা চিকিৎসা নিতে আসেন। আমদানিকারকরা সরবরাহ বন্ধ রাখায় একদিকে মিলছে না সঠিক পরিমাপের রিং, অন্যদিকে দামও ছড়া। এ পরিস্থিতিতে নিম্নআয়ের মানুষ কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার গত ১২ ডিসেম্বর হার্টের রিংয়ের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। দাম নির্ধারণের মার্কআপ ফর্মুলা অনুযায়ী রিংয়ের কেনা মূল্যের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি রেখে দাম ঠিক করে দেওয়া হয়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত থেকে বাংলাদেশ চাহিদার ৬৫ শতাংশ রিং আমদানি করে। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয় ৩৫ শতাংশ রিং।

নতুন মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, ইউরোপ থেকে আমদানি করা ২৭টি কোম্পানির ৪৪ ধরনের রিংয়ের দাম ২ হাজার থেকে ৫৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কমানো হয়েছে। এরপরই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে রিং সরবরাহ না করার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপ থেকে রিং আমদানি করা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। এমনকি ১১টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রিংয়ের মূল্য নির্ধারণের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছে। রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা রিং সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রিং আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা রিং সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছে। কিন্তু পরিমাপমতো না হওয়ায় অনেক রোগী রিং প্রতিস্থাপন করতে পারছে না। ফলে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনরা।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও হার্ট ফাউন্ডেশনে আসা রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম দামে ভালোমানের হার্টের রিংয়ের জন্য তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। আবার কষ্ট করে রিং মিললেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। পাশাপাশি পরিমাপমতো রিং মিলছে না। ফলে চিকিৎসা না নিয়ে বাধ্য হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে রোগীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হার্ট ফাউন্ডেশনের এক চিকিৎসক জানান, রিং সরবরাহ বন্ধের পর থেকে অনেক রোগী চিকিৎসা না নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আগে প্রতিদিন এই হাসপাতালে ৩৫ থেকে ৪০টি রিং পরানো হতো। এখন নেমে এসেছে ২০/২৫টিতে। এর প্রধান কারণ, পরিমাপ মতো রিং পাওয়া যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আরেকজন চিকিৎসক বলেন, আমাদের এখানে আগে গড়ে প্রতিদিন ৪০টির মতো হার্টের রিং প্রতিস্থাপন করা হতো। এখন দিনে ২৫টির মতো হচ্ছে। বেশ কজন রোগীকে ব্লকের পরিমাপমতো রিং পাওয়া না যাওয়ায় অস্ত্রোপচারের কক্ষ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব রোগীর বেশিরভাগ এসেছেন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে।
হাসপাতালে হার্টের রিং সরবরাহ বন্ধ রাখার বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘রিং সরবরাহ বন্ধ রাখায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সামনে সংকট আরও প্রকট হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করা জরুরি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) সূত্র জানায়, হাসপাতালটিতে আগে প্রতিদিন গড়ে ২০টি হার্টের রিং পরানো হতো। সরবরাহ বন্ধের পর তা নেমে এসেছে ১০টিতে। যাদের জরুরি প্রয়োজন, বেশি দামে হলেও তারা রিং পরছেন। কিন্তু দরিদ্র রোগীদের অনেকে ফেরত যাচ্ছেন।

বিএসএমএমইউর হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও মূল্য নির্ধারণী কমিটির সদস্য ডা. এসএম মোস্তফা জামান বলেন, বেশ কিছু কোম্পানি রিং সরবরাহ বন্ধ রাখায় অনেক সময় ব্লকের পরিমাপ অনুযায়ি রিং মিলছে না। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক।

ইউরোপীয় রিং সরবরাহকারী আমদানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, তিনটা কোম্পানি বাদে আমাদের ওপর রিংয়ের দাম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা রিং আমদানি করি। দাম নির্ভর করে মূল উৎপাদনকারী কোম্পানির ওপর। হঠাৎ কয়েকটি কোম্পানির আবেদনের কারণে দাম কমিয়ে দেওয়া হলো, এই দাম কমানোর ক্ষেত্রে মার্কআপ ফর্মুলা মানা হয়নি। এ জন্য গতকাল বৈঠক করেছি। সরকার নির্ধারিত দামে আমাদের পক্ষে রিং বিক্রি করা সম্ভব না। লোকসান দিয়ে কারও পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন।
মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেন, দাম নির্ধারণ করার বিষয়ে ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হার্টের রিংয়ের দাম নিয়ে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এটি দূর করতে হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, হার্টের রিংয়ের দাম নির্ধারণে একাধিক প্রতিষ্ঠানের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি আলোচনা করেই দাম ঠিক করেছে। আজ (মঙ্গলবার) কিছু ব্যবসায়ী এসেছিলেন। আমি তাদের বলেছি, নতুন করে দাম নির্ধারণ করতে হলে কমিটির সঙ্গে আবার বৈঠক করতে হবে। আমার একার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।
দাম বৈষম্য নিরসনে ইউরোপের ২৪টি রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘটের ডাক রোগীদের দুর্ভোগ বেড়েছে এই দুর্ভোগ নিরসনে উদ্যোগ নিবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন. আমি মনে করি না রোগীদের দুর্ভোগ আছে। জাতীয় কমিটিও বলছে রোগীদের দুর্ভোগ নেই। দুর্ভোগ হলে তারা আমাদের জানাবে। তারা যদি মনে করে বড় আকারে সমস্যা হচ্ছে তাহলে তারা নিজেরাই আমাদের কাছে চলে আসবে।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com