সরবারহ বন্ধ থাকায় মিলছে না জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন

ভোগান্তিতে রোগীরা, বাইরে থেকে কেনায় খরচ হচ্ছে বেশি

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।। 
পাগলা কুকুরের কামড়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় দশ বছরের শিশু শাহাদাত হোসেনের। রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর থেকে বুধবার সকালে শিশুটির বাবা শাহ আলম মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে (আইডিএইচ) নিয়ে আসেন জলাতঙ্কের টিকা দিতে। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসককে দেখানোর পর অ্যান্টি র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) ইনজেকশন বা ভ্যাকসিক নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং বলা হয়  হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন নেই। বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে। তখনই বাধে বিপত্তি। শুরু হয় চিকিৎসকের সাথে রোগীর বাবার সাথে ঝগড়া হৈ-চৈ । অবশেষে বাধ্য হয়ে বাইরের ফামের্সী থেকে কিনেই ছেলেকে ভ্যাকসিন দেন শাহ আলম। শুধু এই রোগী নয়, হাসপাতালে আসা সবাইকে জলাতঙ্কের র‌্যাবিস ভ্যাকসিন বাইরে থেকে কিনে এনে রোগীদের পুশ করতে হচ্ছে। এতে করে রোগীদের খরচ যেমন বাড়ছে তেমনি চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে হাসপাতালে আসা কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্যান্য হিংস্র বণ্যপ্রাণীর  কামড়ে দেওয়া শত শত রোগীকে। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে এ দৃশ্য দেখা গেছে। আবার কাউকে কাউকে  ভ্যাকসিন না দিয়ে ফেরত যেতে দেখা গেছে। কারণ একটি ইনজেকশনের  দাম এক হাজার টাকা। অনেক দরিদ্র মানুষ সেই  টাকার ব্যবস্থা  না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাতে অনেকেই আবার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাকসিন সংকটের কারণে গত মাস ধরে অ্যান্টি র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) ইনজেকশন দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে গত ২৭ জুন কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্যান্য হিংস্র বণ্যপ্রাণীর  কামড় বা আঁচড় দেওয়ার সব ধরনের অ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) বন্ধ ছিল। পরের দিন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় এ ভ্যাকসিন চালু করা হয়। আর আরআইজি ভ্যাকসিন না থাকার কথা বিষয়টি স্বীকারও করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে জরুরী বিভাগসহ হাসপাতালে বিভিন্ন জায়গায়  নোটিশও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর এই নোটিশ টাঙানো হয় গত ২৭ জুন। হাসপাতালটিতে প্রতিদিন কুকুর, বিড়াল, শিয়ালসহ প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের ক্ষত নিয়ে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী আসেন।
নোটিশে বলা হয়, জাতীয় জলাতঙ্কে সেন্টারে আগত কুকুর বিড়ালসহ বিভিন্ন হিংস্র  প্রাণীর কামড়/আচরে আক্রান্ত রোগী ও তার স্বজনদের জানানো যাচ্ছে যে,  স্বাস্থ্য অধিদফতরের    সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি)  থেকে  র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন বরাদ্দ বা সরবরাহ না থাকায় এই সেন্টার থেকে আপাতত র‌্যাবিস ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।  তাই এই সেন্টার থেকে উক্ত ভ্যাকসিন পুশ/প্রদান সাময়িক বন্ধ থাকবে। বরাদ্দ বা সরবরাহ প্রাপ্তির পর পরবর্তীতে
আইডিএইচ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং সকলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি। তবে অন্যান্য চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। আদেশক্রমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষতস্থানকে ৩টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে চিকিৎসা হয়। যেমন- কুকুর বা বিড়ালের সংস্পর্শে আসা, খাওয়ানোর সময়, আদরের সময় লালা লেগে গেছে কিন্তু কোনো কামড় বা আঁচড় হয়নি বা কোনো ক্ষতস্থানে লালা লাগেনি সেক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। জায়গাগুলো সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই হবে। আবার কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের ফলে শরীরে ক্ষত থাকে, কিন্তু রক্তপাত হয় না। এর জন্য অ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) নিতে হবে। এছাড়াও কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে শরীরে ক্ষত থাকে এবং রক্তপাত হয়। এ ছাড়া মাথায়, বুকে বা ঘাড়ে কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে রক্তপাত হোক বা না হোক, এক্ষেত্রে রোগীকে জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে। কারণ এই জায়গাগুলো মস্তিষ্কের একদম কাছাকাছি। র‌্যাবিস ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে ফলে মৃত্যু হয়। বিশেষ করে অ্যান্টি র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) ইনজেকশন নিতে হবে।
বুধবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। বিশেষ করে জরুরি বিভাগের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে জলাতঙ্কের টিকা দিতে ভিড় করছেন রোগীরা। তাদের অধিকাংশই  দেশের বিভিন্ন প্রান্ত  থেকে আসছেন। তাদের কাউকে  কুকুর  আবার কাউকে বিড়ালে কিংবা অন্যান্য হিংস্র বণ্যপ্রাণী কামড়ে দিয়েছেন। কোন কোন রোগীর শরীরে সামান্য আচর দিয়েছেন। আবার কারও কারও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এসব রোগীকে সেবা দিতে গলদঘর্ম হন চিকিৎসক ও নার্সরা। অতিরিক্ত রোগীর ভিড়ের কারণে  দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও স্বজনদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে। জরুরী বিভাগের চিকিৎসকরা রোগীদের কামড়ের ক্ষত বিবেচনায় জলাতঙ্কের টিকা দিচ্ছেন। আর যে সব রোগীদের গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে এবং বেশি রক্তপাত হয়েছে তাদেরকে আরআইজির ভ্যাকসিন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। রোগীরা হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন না পেয়ে বাইরের ফামের্সী থেকে কিনে এনে ভ্যাকসিন দিতে দেখা গেছে। এতে  অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
কুকুরের কামড়ে ঢাকার উত্তরা থেকে এসেছেন আজিজুল ইসলাম। তিনি  বলেন, দুইদিন আগে এলাকায় এক কুকুর কামড় দেয়। আজ হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, যেহেতু কুকুর অনেক জোরে কামড় দিয়েছে তাই অনেক বড় ক্ষত হয়েছে। এজন্য চারটি ভ্যাকসিন নিতে বলেছেন। কিন্তু হাসপাতালে  তিনটি ভ্যাকসিন আছে। একটা  নাই তাই বাইরে থেকে এক হাজার দিয়ে কিনেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকারি হাসপাতালে কেন ভ্যাকসিন থাকবে না। আমরা টাকা আছে কিনেছি। এখানে আসা রোগীদের সেই সামর্থ্য নেই তারা কি করবে। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কি করে দুই মাস ভ্যাকসিন বন্ধ থাকে -এগুলো কি দেখার কেউ নেই?
বিড়ালের কামড়ে আহত হয়ে ছয় বছরের রামিসাকে নিয়ে এসেছেন তার মা রাশিদা বেগম।
তিনি  অভিযোগ করে বলেন,  রাজধানীর একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রটি এটি। প্রতিদিন কুকুরসহ অন্যান্য প্রাণির আক্রমণে অসংখ্য আহত মানুষ এখান  সেবা নেন। অথচ এখানে আসার পর বলা হচ্ছে ভ্যাকসিন নেই এটা কোন কথা।
তিনি জানান, ভ্যাকসিন নেই ভাল কথা  কিন্তু কর্মচারির কিছু টাকা দিলেই আরআইজি ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে। ফামের্সী থেকেও কিনতে হয় না। আমি তাই তাই করেছি। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয়।
গাজীপুর থেকে আসা আরেক রোগীর বাবা নয়ন বর্মন  বলেন, সরকারি  হাসপাতাল যদি ওষুধ না পাওয়া যায় তাহলে মানুষ কোথায় যাবে। আমাদের মত সাধারণ রোগীদের তো যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
এ ব্যাপারে হাসপাতালে জরুরী বিভাগের চিকিসক ডা. শাহনাজ পারভীন  বলেন,  আমাদের এখানে গত দুই মাস ধরে আরআইজি ভ্যাকসিক সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তাই এখান থেকে রোগীদের দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। যদি কোন রোগীর প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা বাইরে থেকে কিনে আনার পরামর্শ দিচ্ছি। তখন সেই ভ্যাকসিন আমরা পশু করছি। এজন্য রোগীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এখানে তো আমাদের কিছুই করার নেই।
রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার বলেন, আমাদের এখানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিডিসি শাখার অধীনে অপারেশন প্ল্যানের আওতায় জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে র‌্যাবিস ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু অপারেশন প্ল্যান না থাকায় এসব বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে সরবরাহ না থাকায় এআরভির ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম একদিন বন্ধ ছিল। পরে অধিদফতর থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ভ্যাকসিন এনে কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু এখনো  আরআইজি ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। রোগীদেরকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাইরে থেকে কিনে দিতে হচ্ছে।  এজন্য আমরা খুবই দু:খিত।
তিনি জানান, অনেক আগে থেকেই সিডিসি থেকে অপারেশন প্ল্যানের আওতায় র‌্যাবিস ইলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভ্যাকসিন ক্রয় করা হতো। অপারেশন প্ল্যান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সমস্যা হয়েছে। তবে একটি এক্সিট প্ল্যানের (বিকল্প ব্যবস্থা) মাধ্যমে ইতোমধ্যে জাতীয় ঔষাধাগার (সিএমএসডি) থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় করা হয়েছে। কিন্তু ভ্যাকসিনগুলো বিতরণের আগে একটি সার্ভে করা হয়। এটির জন্য দেরি হচ্ছে। তবে আমরা অনুরোধ করেছি যে, আমাদের পরিস্থিতি খুব খারাপ। অধিদফতর  বলছে, খুব দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে – এমন আশাবা ব্যক্ত করেন এই  চিকিৎসক।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com