ডা. আয়শা আক্তার।।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জেঁকে বসেছে শীত। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আর ঘন কুয়াশার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে তীব্র ঠান্ডা। সেইসঙ্গে বইছে হিমেল বাতাস। প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। গত দুদিন রাজধানীতে দেখা মেলেনি সূর্যের। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন নগরী।এ সময় হাড়কাঁপানো শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। একই সঙ্গে পরিবেশের শুষ্কতার কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্পের মাত্রা বা আর্দ্রতা কমে যায়। এ কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের ভেতরে সহজেই জীবাণু প্রবেশ করে। কিন্তু শরীর থেকে তা সহজে বের হয় না। তখন জীবাণুরা বংশ বিস্তার করে ও শ্বাসতন্ত্র আক্রমণ করে। এ সময় বায়ুদূষণের মাত্রাও অনেক বেড়ে যায়, যা শ্বাসকষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ।
আরেকটি হলো ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট, যার তীব্রতা প্রথমে কম থাকে, পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং খারাপের দিকে যায়। ফুসফুসের ভেতরে এক রকমের তরল নিঃসৃত হয়, যাকে ব্রঙ্কিয়াল নিঃসরণ বলে। এ তরলের সাহায্যে শ্বাসতন্ত্রের ভেতরে থাকা সিলিয়া কোষ, শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকে পড়া ধুলাবালি ও জীবাণুকে বের করে দেয়। কিন্তু বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় শ্বাসতন্ত্রে শুষ্কভাব তৈরি হয়। শীতের সময় শুষ্ক পরিবেশে ধুলাবালি বাতাসে বেশি ভেসে বেড়ায়। ধুলাবালি, যানবাহনের ধোঁয়া এবং শিল্পকারখানার বর্জ্য মিলে এ দূষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। শীতকালে কুয়াশার কারণে দূষিত কণা বাতাসে বেশি সময় ধরে মিশে থাকে। এর ফলে বাতাস ভারী হয়ে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। দূষিত বায়ু থেকে সাধারণত ফুসফুস সম্পর্কিত রোগ হয়। এর মধ্যে অ্যাজমা বা হাঁপানি, অ্যালার্জি, চর্ম রোগ, শ্বাসকষ্ট, কাশি, বমি অন্যতম।
ঋতু পরিবর্তনের এ সময়টা সবারই সর্দি, ঠান্ডা, কাশি, জ্বর লেগে থাকে। এসব থেকে রেহাই পেতে সবারই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে হবে। তার জন্য দরকার নিয়মমতো রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো। স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যতালিকায় ভিটামিন সি জাতীয় খাবার, সবুজ শাকসবজি বেশি পরিমাণে রাখা।
শীতে শিশু এবং বয়স্কদের নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তাই তাদের দিকে বাড়তি খেয়াল রাখতে হবে। শীতে কাপড়-চোপড় ঠিকমতো পরিধান করতে হবে। বাইরে বের হলে ঠান্ডা যাতে না লাগে সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে এবং একটু কুসুম গরম পানি পান করতে হবে। সেই সঙ্গে হালকা কুসুম গরম পানিতে প্রতিদিন গোসল করা দরকার। শিশুরা খেলাধুলা করার সময় ঘেমে যায়, তাই ঘামটা ভালোমতো মুছে দিতে হবে এবং রাতে যখন তারা লেপ বা কম্বলের নিচে ঘুমাবে তখন ঘেমে যাচ্ছে কি না সেদিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শীতের সময় শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ত্বকও শুষ্ক হয়ে ওঠে। ফলে অনেক সময় চুলকানি হয় অথবা চামড়া ফেটে যায়। নিয়মিতভাবে লোশন বা অলিভ অয়েল, গ্লিসারিন ব্যবহার করা যেতে পারে। তা হলে চামড়া স্বাভাবিক থাকবে। ধুলাবালি থেকে অ্যালার্জিটা খুব বেশি হয়ে থাকে, হাঁচি-কাশি হতে পারে। তাই ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি বাইরে বের না হওয়াই ভালো। ত্বকের বিশেষ সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্রিম বা মলম ব্যবহার করা উচিত। নিজে থেকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক-ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
রোগ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসাটা সঠিকভাবে নিলে সুস্থ থাকা যায়। যাদের অ্যাজমা বা হাঁপানি আছে শীতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেয় তাদের ক্ষেত্রে। রোগীরা যদি ঠিকমতো ইনহেলার ব্যবহার না করে তাদের শ্বাসকষ্ট বেশি হয়ে থাকে। তাই যাদের অ্যাজমা বা হাঁপানি আছে তাদের অবশ্যই ইনহেলার ঠিকমতো ব্যবহার করতে হবে। অ্যাজমা বা হাঁপানির একমাত্র চিকিৎসা সঠিকভাবে ইনহেলার ব্যবহার করা। আর জানতে হবে- ইনহেলার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।
শীতে সুস্থ থাকতে বাইরে বের হওয়ার সময় একটি মাফলার দিয়ে নাক-মুখ ভালো করে ঢেকে অথবা মাস্ক পরে বের হতে হবে। কারণ শীতের ঠান্ডা বাতাস নাক-মুখ দিয়ে ভেতরে গেলে বা ফুসফুসে প্রবেশ করলে অ্যাজমা রোগীরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস এবং আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসনালিকে সংকুচিত করে। এ কারণে শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে যায়। অনেকেই ঠান্ডায় আগুন পোহায়, সেখান থেকে দগ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
ডা. আয়শা আক্তার,পরিচালক, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা।