নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশসহ বিশ্বে টাইপ-২ ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করেছে। আক্রান্তদের অর্ধেকই জানেন না যে, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রার ফলে শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামগঞ্জে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা।অথচ জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমে নীরব ঘাতক এই ডায়াবেটিস বহুলাংশে অর্থাত্ ৭০ শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একইসঙ্গে ডায়াবেটিস পরীক্ষায় ব্যবহৃত স্ট্রিপ, ইনসুলিন এবং মুখে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছে ডায়াবেটিস রোগীরা।
২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামের ১৪ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস আক্রান্ত।
এমন পরিস্থতিতে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে আজ বুধবার দেশব্যপী পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস-২০২৪ পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছেÑ‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধের এখনই সময়’।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের অভাব হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকরিতা কমে গলে রক্তের গ্লুকোজ দেহের বিভিন্ন কোষে প্রয়োজনমতো ফুকতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিকেই ডায়াবেটিস বলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস একবার হলে সারা জীবন থাকে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক, মাড়ির রোগ ও পঙ্গুত্বের মতো কঠিন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের; টাইপ-১ ও টাইপ-২। সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সীদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা যায়। এ ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন নিতে হয়। দেশে টাইপ-১ রোগীর সংখ্যা কম। প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ রোগী টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এদের শরীরে ইনসুলিন নিস্ক্রীয় থাকে অথবা ইনুলিনের ঘটতি থাকে। এ ধরনের রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যভাস পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। কারও কারও ক্ষেত্রে মুখে খাওযার ওষুধ ও ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
দেশে গ্রামীন জনগোষ্ঠির ডায়াবেটিস পরিস্থিতি জানতে ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শাখা যৌথভাবে একটি সমীক্ষা করেছে। এ কাজে সহায়তা করছে সমাজে ধর্মীয় নেতা হিসেবে পরিচিত মসজিদের ইমামরা।
২০২২ সালের আগস্ট ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১২ মাস দেশের আটটি উপজেলায় সমীক্ষাটি চালানো হয়। এ জন্য দৈবচয়ন ভিত্তিতে দেশের আটটি উপজেলা বেছে নেওয়া হয়। এলকাগুলো হলোÑ মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও শিবালয়, নরসিংদীর মনোহরদী ও রায়পুরা, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, টাঙ্গাইলের ধানবাড়ি ও সখীপুর। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং সম্পর্কিত অসংক্রামকি রোগের প্রকোপ রয়েছে। এগুলো মূলত জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য করা যায়।
সংশ্লিষ্ট উপজেলার দেড় হাজার কেন্দ্রে ১২ হাজার মানুষের উপর সমীক্ষাটি করা হয়। এরমধ্যে ১০ হাজার ২২৩ জনের ডায়াবেটিস ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়। এতে অংশ নেওয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে ৬ হাজার ৭০৪ জন নারী (৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং ৩ হাজার ৫১৯ জন (৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ) পুরুষ ছিলেন। তাদের গড় বয়স ছিল ৪৩ দশমিক ৬ বছর। ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতাদের বয়স ৪০ বছরের উপরে। উত্তরদাতাদের প্রায় ৮৮ দশমিক ৬ শতাংশ নিু এবং মধ্যম আয়ের গোষ্ঠীভুক্ত। ৪২ দশমিক ৬ শতাংশের কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ গৃহিনী ছিল। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ তামাক ব্যবহার করেন। ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ দৈনিক পাঁচটি শাকসবজি বা ফল খায় না। ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ শারীরিক পরিশ্রম করেন না এবং ২০ দশমিক ৬ শতাংশের ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস ছিল।
এছাড়া কার্ডিওমেটাবলিক সহ ৪৬ দশমিক ২ শতাংশের সাধারণ স্থূলতা, ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশের পেটের স্থূলতা, ২৮ দশমিক ৬ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ১৪ দশমিক ২ শতাংশের ডায়াবেটিস এবং ১৮ দশমিক ৭ শতাংশের প্রিডায়াবেটিস ঝুঁকি হার ছিল। ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী তাদের রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। প্রায় ৯২ দশমমিক ৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারীদের কমপক্ষে একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির কারণ ছিল। ৭ দশমিক ৪ শতাংশের নিু ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশের মাঝারি এবং ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশের উচ্চ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ছিল। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া নারী-পুরষ উভয় বয়সীদের পেটের স্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, শাকসবজি জাতীয় খাদ্য কম খাওয়া।
ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ এর প্রকল্প পরিচালক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক বলেন, ডায়াবেটিস-সেবা তৃণমূল পর্যন্ত পৌছে দিতে এবং রোগটি প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ধর্মীয় নেতাদেরকেও সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। মসজিদে খুতবার মাধ্যমে এবং অন্যান্য ধর্মশালায় ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ মসজিদে ডায়াবেটিস কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এ উদ্যোগ নেয়া হবে। অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলিতেও বিশেষ করে মন্দির ও গির্জায়ও একই ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সহায়তায় সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে সকল স্তরের মানুষকে এর সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল পরিচালক (একাডেমি) এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান বলেন, সুস্থ জীবনযাপনের মাধ্যমে এ রোগের প্রকোপ শতকরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি কায়িক পরিশ্রম ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে ৮ থেকে ৩০ শতাংশ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। আইডিএফ এ ব্যাপারে তিনটি পদক্ষেপ নিতে উপদেশ দিয়েছে। ডায়াবেটিস সনাক্ত করা, ঝুঁকি পর্যালোচনা করা এবং প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেওয়া।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুসারে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে উদ্বেগের কারণ হলো দেশের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ জানেই না তারা রোগটিতে আক্রান্ত। রোগটি প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আগামী ২০৪৫ সালে রোগীর সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখের বেশি হতে পারে।ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। রোগটি ধরা পরার পর থেকে অনেকই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মাদ ইব্রাহিমের মতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র- থ্রি ডি, অর্থাৎ ডিসিপ্লিন, ডায়েট অ্যান্ড ড্রাগ। খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রণ, শৃংখলা মেনে কাজকর্ম, ব্রিশাম ও ঘুমের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এদিকে প্রতিবছর ২৮ ফেব্র“য়ারি দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি’র (বাডাস) ৬৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। দিবসটি উপলক্ষে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সমিতির অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত অধিভুক্ত সমিতিগুলিও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। আজ সকাল সাড়ে আটটায় বারডেমে ‘সচেতনতামূলক শ্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করা হবে। দুপুর ১২টায় বারডেম অডিটোরিয়ামে (তৃতীয় তলা) আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন উপস্থি আদর্শ ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে ক্রেস্ট প্রদান করবেন। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বারডেম ক্যাম্পাস এবং এনএইচএন ও বিআইএইচএস-এর বিভিন্ন কেন্দ্র সংলগ্ন স্থানে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হবে। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল এ উপলক্ষে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত (চতুর্থ তলা) হ্রাসকৃতমূল্যে হার্ট ক্যাম্পে করা হবে।