নিজস্ব প্রতিবেদক।।
আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশাগ্রীষ্ম-বর্ষায় বেশি জন্মায় এবং এই সময়ে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। দেশের তিনটি পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। গত বছর এইসব জেলায় মোট আক্রান্তের হার ছিল ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর বাইরে কক্সবাজারের হার ছিল ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের প্রায় ৯৯ শতাংশই চার জেলার রোগী। এছাড়াও ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সীমান্তবর্তী ৩৬ টি উপজেলার সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া ঝুঁকিতে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক যুগে দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫৫ এবং মোট আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৬ জন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১৫ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৬ হাজার ৮৯১ জন। পরে ২০২০ সালে মৃত্যু ৯. আক্রান্ত ৬ হাজার ১৩০ জন, ২০২১ সালে ৯ জনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত ৭ হাজার ২৯৪ জন, ২০২২ সালে ১৪ জনের মৃত্যু আক্রান্ত ১৮ হাজার ১৯৫ জন, ২০২৩ সালে ৬ জনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত ৬ জন এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি- মার্চ পর্যন্ত ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা হয়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৩৪ জনের। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৫৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫০৩ শনাক্ত হয়েছে রাঙামাটিতে। তার পরে ৪৬০ জনের শনাক্ত হয়েছে বান্দরবানে. কক্সবাজারে ১৩৮ জনের, খাগড়াছড়িতে ৪০ জনের এবং কক্সবাজারে ১৩ জনের। তবে দেশে ২০০০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে। ওই বছরে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ১৫৪ জন মারা যায়। পুরো বিশ্ব ম্যালেরিয়ামুক্ত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ২০৫০ সালে। কিন্তু আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে চিরতরে ম্যালেরিয়ার নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের হাতে আছে আর মাত্র ৬ বছর। এই সময়ের মধ্যে পরপর তিন বছর ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য থাকতে হবে। এর পরই কেবল মিলবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ম্যালেরিয়ামুক্ত’ সনদ।
তাই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার কারণে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঠেকানো যাচ্ছে না। পার্বত্য জেলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ম্যালেরিয়ার পরিস্থিতি এখনো বেশ উদ্বেগজনক। উঁচু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, যেমন জুমচাষী, বাঁশ-গাছ কাটার শ্রমিক, বন বিভাগে কর্মরত কিংবা অল্প সময়ের জন্য কাজ করতে আসা লোকজন কিংবা ভ্রমণকারীদের জন্য ম্যালেরিয়া বাহক মশা নিয়ন্ত্রণে গতানুগতিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে নানামুখী আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসূচি, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘ন্যায়সঙ্গত বিশ্বের জন্য ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই আরও গতিশীল করতে হবে’।
চিকিৎসকরা জানান ম্যালেরিয়ার মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের এক ধরনের অণুজীব। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এরমধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। সংক্রমিত বাহক স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে তখন তার রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে। ম্যালেরিয়া হলে কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়। এই রোগের প্রধান লক্ষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা। জ্বর ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। তবে অনেক সময় নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে। এগুলো ছাড়াও মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব, মাথা ধরা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বমি বমি ভাব, খিঁচুনি, পিপাসা লাগা, ক্লান্তি বা অবসাদ ও মাংসপেশি, তলপেটে ব্যথা অনুভব করা এবং রক্তশূন্যতাসহ ম্যালেরিয়া রোগের কিছু উপসর্গ রয়েছে। কারো ম্যালেরিয়া হয়েছে কি না এটা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী এক সপ্তাহে সুস্থ হয়ে যায়। তবে কোনো সময় রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।
ম্যালেরেয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ড. বেনজির আহমেদ বলেন, ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে কমলেও ২০৩০ সালের মধ্যে জিরো কিংবা শূণ্যের কোঠার নিয়ে আসা খুবই কঠিন। কারণ আমাদের যে পদ্ধতিতে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা হচ্ছে সেখানে বড় ঘাটতি হলো মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। মশা দমন করার পদ্ধতি এবং রোগী শনাক্তে তথ্য-উপাত্ত ব্যবস্থা খুবই দূর্বল। মশা নিমূলের আধুনিক অনেক পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি নিয়ে সরকারকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। একই সঙ্গে জনবল নিয়োগসহ ম্যালেরিয়া নির্মূলে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
পাহাড়ী ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ম্যালেরিয়া রোগী কেন কমছে না এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ম ম আক্তারুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের নিদিষ্ট বাউন্ডারি রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে পার্বত্য তিন জেলার ক্রস বর্ডার ইস্যু রয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় অত্যন্ত ম্যালেরিয়াপ্রবণ। ওইসব এলাকা থেকে সীমান্তে অতি সহজেই ম্যালেরিয়া জীবাণুবাহিত মশা প্রবেশ করতে পারে। ফলে আমাদেরও ঝুঁকি এবং প্রকোপ অনেক বেশি। আর পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ রোগী বান্দরবানে। মশা নিয়ন্ত্রণ ও ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা সেখানে কমে আসে ওয়ান থ্রি সেভেন ফর্মূলা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। অর্থাৎ ম্যালেরিয়া রোগের শনাক্তকরণ করতে হবে একদিনের মধ্যে, ৩ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ম্যালেরিয়া নিশ্চিত করে রিপোর্ট দিতে হবে এবং ৭ দিনের মধ্যে আশ-পাশে কোন রোগী আছে কি-না তারও খোঁজ নিতে হবে। এই ফর্মূলা ব্যবহার করে চীন ম্যালেরিয়া নির্মূল করেছে। প্রতিটি কেইসকে আমরা ফলো করছি। স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিল্যান্স বৃদ্ধি করাসহ বিনামূলে মশারি এবং ওষূধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লক্ষ্যপূরণে সরকার ও এনজিওগুলো আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা দাঁিড়য়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কিছু এলাকায় আছে যেখানে রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা যদি আগতরতলাসহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী ক্রসগুলো ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারি তাহলে টার্গেট অনুযায়ী নিদিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে কোন সমস্যা হবে না। আর ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্তের পাশাপাশি দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা জরুরী ।
দেশে ম্যালেরিয়া ম্যালেরিয়া নির্মূলের প্রধান বাঁধাগুলো কি এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, প্রথমত আমরা যে প্রক্রিয়ায় ম্যালেরিয়া নির্মূল করছি, তা হয়তো একটা মাইলস্ট্রোন পর্যন্ত এ্যাচিভ করা যাবে।কারণ গত পাঁচ/সাত বছরের ম্যালেরিয়া পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে রোগীর আক্রান্তের সংখ্যা প্রায়ই কাছাকাছি। ম্যালেলিয়া নির্মূলের যে পদ্ধতিগুলো অনেক বছর ধরেই একইপদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে মশা নির্মূল কিংবা রোগীর সংখ্যা কমছে না। কিন্তু এখন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তখনই কমানো সম্ভব হবে। যেমন পাহাড়ী এলাকায় কিংবা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো বনে কাঠ কাটতে যায়, রাতে গরু পাচার করে এবং জুম চাষ পাহাড়া দেয় তারা তো মশারি নিয়ে যায় কিংবা মশারি ব্যবহার করার সুযোগ নেই। তাদের ক্ষেত্রে মসকিউটো রিপেল্যান্ট প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ কিছু ইনোভেটিভ সলিউশান কিছু কিছু মানুষের জন্য নিতে হবে।
পাহাড়ী এলাকায় ম্যালেরিয়া নির্মূল না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সব এলাকাগুলো হচ্ছে মূলত চোরাকারবারিদের আস্তানা। বর্ডারের সাথে সব সময় যাতায়াত থাকে। নিরিবিলি নিরব এবং মানুষ খুব কম থাকে। ফলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আর আমাদের দেশের সাথে ভারত ও মায়ানমানের সাথে বর্ডার জড়িত। তাই ম্যালেরেয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এপাশ ওপাশ দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। আরেকটি বিষয়টি হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের যে সব জায়গায় যাওয়া খুব কঠিন যেসব এলাকার স্থানীয় মানুষদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা সম্ভব না।
গবেষনায় রাজধানী ঢাকাতে ম্যালেরিয়ার বাহক পাওয়া গেছে উল্লেখ করে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া এবং লেশম্যানিয়াসিস ইত্যাদি রোগ বছরের পর বছর ধরে দেশের জনস্বাস্থ্যের প্রধান উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বহু মানুষের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর কারণে হুমকির হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নতুন নতুন করে আমাদের মাঝে এক ধরনের শষ্কা তৈরি করছে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ ।