নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের মধ্যে অসংখ্য রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেও এখনো মানসিক ট্রমায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন মানসিক বিশেষজ্ঞরা। তবে ট্রমায় ভোগা এরকম হাজারো রোগী থাকলেও তাদের চিকিৎসা সেবা দিতে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সাইকিয়াট্রিস্ট নেই বলে দাবি তাদের। এছাড়াও দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গুলোতে জরুরি বিভাগ থাকলেও বেশিরভাগ মেডিক্যালে নেই মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা। এমন কি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞও নেই। মনস্তাত্ত্বিক সেবার হারও অপ্রতুল। এ অবস্থায় ঢাকাসহ সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের পদ সৃষ্টির দাবি জানানো হয়েছে।
শনিবার (৯ নভেম্বর) দুপরে রাজধানীর শেরবাংলা নগর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মেন্টাল হেলথ ২.০ শীর্ষক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে এসব তথ্য জানানো হয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াস্ট্রিস্টস (বিএপি) সেমিনারটি আয়োজন করে। সেমিনারে দেশের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মোট তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
বৈজ্ঞানিক সেমিনারটিতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি)-এর আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মোত্তালিব, সূচনা বক্তব্য দেন বিএপি এর সদস্য-সচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড্যাবের সহ-সভাপতি ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস, এনডিএফ এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সাজেদ আবদুল খালেক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মুনতাসীর মারুফ প্রমুখ।
মানসিক স্বাস্থ্যে আগামীর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্টার ডা. তৈয়বুর রহমান ।
তিনি বলেন, একজন মানুষ সন্ধার সময় যদি আগ্রাসি বা অস্বাভাবিক আচরন করে তাকে নিব্রিত করতে বা চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ কেবল মাত্র জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রয়েছে। আর কোথাও নেই।
দেশের সরকারি ৩৫ টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক রোগ বিভাগ নেই। ওষুধ দিয়ে মানসিক রোগী শান্ত করা পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য রিহ্যাবিলিটেশন প্রয়োজন এটি সবাই স্বীকার করে কিন্তু কাজ খুবেই সীমিত।
তিনি বলেন, ভর্তি রোগীর হিসেবে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ২০ কোটি মানুষের জন্য শয্যা রয়েছে এক হাজার ২১০ টি। এর মধ্যে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে তিনশ, পাবনায় পাঁচশ শয্যা, বিএসএমএমইউ’তে ৪০ শয্যা, সরকারি ৩৫ টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা রয়েছে মাত্র ১৫০ টি। সিএমএইচে ২০ শয্যা ও ড্রাগ এডিকশনে ( স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধিনস্ত) ২০০ শয্যা।
ডা. তৈয়বুর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে জাতীয় জরিপ অনুযায়ি দেশের প্রাপ্ত বযস্কদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ হচ্ছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ জনে এক কোন না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এই হার শিশু কিশোরদের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রাপ্ত বয়স্কদের চিকিৎসায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছে ৩৫০ জন। সে হিসেবে প্রতি লাখ মানুষের জন্য ০. ১৭ জন। অন্যান্য জনবলের মধ্যে সাইকোলজিস্ট প্রতি লাখে ০.৩৪ জন, সোসাল ওয়ার্কার ০.০০৪ জন, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ০.১৮ জন। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কর্মরত জনশক্তি প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ০.৫০ জন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যাত্থানে সরকার পতনের তিন অতিবাহিত হলেও বৈষমের শিকার চিকিৎসকদের কাঙ্খিত পদোন্নতি, তাদের আশা- আঙ্খাংকার কোন প্রতিফলন ঘটেনি। এর পেছনে অনেকে কারণ আছে, অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তবুও আমরা আশাবাদি, তরুনদের যে তৎপরতা তাতে পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সাজেদ আব্দুল খালেক বলেন, গণঅভ্যাত্থানে দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেছে এদের সংখ্যা ২২ জন। কমপক্ষে ছয় শতাধিক যাদের এক চোখ অন্ধ। যাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরে মধ্যে। তাদের আৎত্যাগ ও অবদান আমাদের কাজে লাগে হবে।
সেমিনারে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, আন্দোলনে আহত অনেক শিক্ষার্থী শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও এখনো মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। আমি একজনকে চিকিৎসা দিয়েছি, যার শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও সে মনে করে তার শরীরে গুলির মাধ্যমে একটি মাইক্রোচিপ প্রবেশ করেছে, যার মাধ্যমে তাকে ট্র্যাক করা হচ্ছে। যদিও বিষয়টি ভিত্তিহীন। সে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। আমরা তাকে সহযোগিতা করছি।
তিনি আরও বলেন, তার মতো আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে। তারা মিছিলের আওয়াজ শুনে, ঘুমাতে পারে না, ভয় পায়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) উত্তরের সভাপতি ডা. আসাদুজ্জামান কাবুল বলেন, আমাদের দেশে তরুণরা আন্দোলন করেছে দেশ থেকে বৈষম্য দূর করার জন্য। আমরাও চেষ্টা করছি দেশের সব জায়গায় বৈষম্য দূর করতে। বিগত সময় আমরা এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারতাম না, আসতে পারতাম না। আমরা এখন আসার সুযোগ পাচ্ছি, বৈষম্য দূর করে একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করব।
এসময় সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ডা. মোসাদ্দেক হোসেন মানসিক চিকিৎসকদের ভূমিকা বিএমডিসির মাধ্যমে মূল্যায়ন করার আহ্বান জানান তিনি ।