নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন, তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানকে পারিবারিক কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামে জানাজা শেষে তাঁদের সমাধিস্থ করা হয়। সেখানে প্রথমেই আছে মোবারক হোসেনের একমাত্র ছেলে সৈয়দ আবদুল্লাহর কবর। এরপর সৈয়দ মোবারক, তাঁর স্ত্রী স্বপ্না আক্তার, দুই মেয়ে ফাতেমা তুজ জহুরা ও সৈয়দা আমেনা আক্তারকে কবর দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (২ মার্চ) দুপুরে শাহবাজপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামজুড়ে এখনো শোকাবহ পরিবেশ। গ্রামের লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে পাঁচজনের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা কবরগুলোতে বেড়া দেওয়ার কাজ করছেন।
স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্রাণ হারানো ইতালিপ্রবাসী মোবারকের মায়ের আহাজারি থামছে না। সন্তান, পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিদের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকে মোবারকের মা হেলেনা বেগম (৭৫) নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এখনো বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমার ছেলে বলেছে, মা, এবার সবাইকে নিয়ে ইতালি চলে যাব। অনেক কাজ। তাই এবার বেশি দিন বাড়িতে থাকতে পারব না। ছেলে আসবে, তাই আমি পোলার চাল, পিঠার চাল, গাছের ফল রেখেছিলাম। এসব অহন কে খাবে? ছেলে বলছে বেশি দিন থাকবে না। এখন চিরদিনের জন্যই থেকে গেল।’
মোবারক হোসেনের স্বজন ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হেলেনা বেগমের তিন ছেলে আর এক মেয়ে। স্বামী সৈয়দ আবুল কাশেম মারা গেছেন দুই যুগ আগে। বড় ছেলে সৈয়দ সোয়েব হাসান আর মেজ ছেলে সৈয়দ মোবারক হোসেন ইতালিপ্রবাসী। একমাত্র মেয়ে সৈয়দা হাজেরা বেগম লন্ডনপ্রবাসী। সোয়েব স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ইতালিতে থাকেন। আর মোবারক ইতালিপ্রবাসী হলেও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না আক্তার (৪২), বড় মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সৈয়দা ফাতেমা তুজ জহুরা (১৯), ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সৈয়দা আমেনা আক্তার (১৩) ও একমাত্র ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সৈয়দ আবদুল্লা (৮) থাকতেন ঢাকায় নিজেদের ফ্ল্যাটে। তাঁদের সবারই ২২ মার্চ ইতালি চলে যাওয়ার কথা ছিল।
নিহত মোবারক হোসেনের ছোট ভাই সৈয়দ আমির হামজা বলেন, মোবারক হোসেন পরিবারের মেজ সন্তান হলেও তিনি সবার আগে সংসারের হাল ধরেছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি ইতালি যান। প্রতিবছর বাড়িতে আসতেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই যত সম্পদ করেছেন, সবই করেছেন মায়ের এবং সব ভাই-বোনের নামে। তিনি একক নামে কিছুই করেননি। ভাইয়ের ১৫ বছরের স্বপ্ন ছিল স্ত্রী-সন্তানদের ইতালি নিয়ে যাবেন। তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হলো না।’
পেটের দাগ থেকে ভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত
এদিকে, রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় মারা যান কে এম মিনহাজ উদ্দিন (২৬)। পেটে অস্ত্রোপচারের দাগ থেকে বড় ভাই আমিনুল ইসলাম তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন। আজ শনিবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে মিনহাজের মরদেহ ভাই আমিনুলকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাবিবুর রহমান বলেন, আগুনের ঘটনায় দগ্ধ মিনহাজের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মিনহাজের ভাই ঘড়ি ও পেটের অস্ত্রোপচারের দাগ দেখে মৃতদেহ শনাক্ত করেন। তবে অন্য একটি পরিবার লাশ দাবি করায় মিনহাজের মরদেহ ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভাইয়ের মরদেহ বুঝে পাওয়ার পর আমিনুল ইসলাম বলেন, মিনহাজের ছোটবেলায় পেটে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তাঁর ছোট ভাইয়ের সামনের কয়েকটি দাঁত উঁচু ছিল। হাতে ছিল তাঁরই দেওয়া একটি ঘড়ি। তিনি আরও বলেন, অস্ত্রোপচারের দাগ, দাঁত ও হাতঘড়ি দেখে ভাইকে শনাক্ত করেন আমিনুল। তবে আরেকজন দাবি করায় মরদেহ বুঝে পেতে তাঁদের সময় লেগেছে।
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, ‘আব্বা আগুন লাগছে, দোয়া কইরো, আম্মারে বইলো আমার জন্য দোয়া করতে, বাইচ্চা থাকলে দেখা হবে।’ বেইলী রোডের অগ্নিকান্ডের সময় ভবনের ছাদে উঠে এই কথাগুলো বাবাকে ফোনে বলেছিল নিহত নাইম। এরপর আর কথা হয়নি। পূত্র শোকে নিথর নিস্তব্ধ বাবা নান্টু মিয়া। বিলাপ করতে করতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন নাইমের মা লাকি বেগম। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনদের ভিড় আর শোকে স্তব্ধ নাইমের গ্রামের বাড়ির গোটা এলাকা।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডে নিহত হন মো. নাইম। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৩নং ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের ছোট গৌরীচন্না। দুই ভাই-বোনের মধ্যে নাইম বড়। বাবা নান্টু মিয়া পেশায় ভ্যান চালক, মা লাকি বেগম গৃহীনি।
মা-বাবা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মেধাবী ছেলে নাঈমকে এইচএসসি পাশ করিয়েছেন। বাবা মা’র কষ্ট লাঘব আর একমাত্র বোনকে পড়াশোনার করার দায়িত্ব নিতে একমাস আগে কাজের সন্ধানে রাজধানী ঢাকায় গিয়েছিলেন নাঈম। মাত্র তিনদিন আগে বেইলী রোডের কাচ্চি ভাই বিরিয়ানি হাউজের ওই বিল্ডিংয়ে একটি কোম্পানিতে কাজ নেয় নাঈম। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নাঈমের এমন অকাল মৃত্যুর খবরে এলাকা জুড়ে বইছে শোকের মাতম। বাড়িতে ছুটে এসেছেন পাড়াপ্রতিবেশিসহ সহপাঠীরাও।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহত নয়ন ও জুনাইদ এর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সন্তানকে হাঁরিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন স্বজনরা। নিহত নয়নের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নের চর কুমারিয়া গ্রামে। তিনি দিনমজুর সিরাজ উদ্দিনের ছেলে এবং দুর্ঘটনা কবলিত কাচ্চি ভাই বিরানীতে হোটেল বয় হিসেবে চাকুরী করতেন তিনি।
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, পোলাডায় আমারে থুইয়া আগেই চইল্যা গেল। অ্যাহন আমার কী হইবে- পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এ কথাগুলো বলে আহাজারি করছিলেন গাজী মো. জুয়েল রানার মা ফাতেমা বেগম।
জুয়েল রানা ঢাকার বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগার পর নিজেকে বাঁচাতে জানালা ভেঙ্গে নামতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ওই ভবনটির সাত তলায় ‘এমবাসিয়া’ নামে একটি রেস্তোরায় বাবুর্চির (সেফ) কাজ করতেন। পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, চার-পাঁচ বছর ধরে তিনি ওই রেস্তোরায় কাজ করেন।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম মধুখালী গ্রামে জুয়েলের বাড়ি। তাঁর বাবার নাম মো. ইসমাইল গাজী। স্ত্রী রেবেকা সুলতানা এবং মেয়ে তাসমিম (৮), ছেলে তাইফুরকে (৩) নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। পরিবার নিয়ে তিনি ঢাকার বেইলি রোডের কাছাকাছি একটি এলাকায় বসবাস করতেন।
বেইলি রোডের ভবনটিতে আগুন লাগার পর জানালা ভেঙে নামতে গিয়ে গাজী মো. জুয়েল রানা মৃত্যুবরণ করেন। একই রেস্তোরাতে তাঁর আপন ভাগিনা রাকিব আকনও কাজ করতো।