‘বেঁচে থেকেও যেন মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছি’

বিদেশ নিয়ে দ্রুত  চিকিৎসা করার দাবি পরিবারের

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
আমি গত বছর পূজোর এই সময়ে বন্ধু -বান্ধব পরিবার আত্মীয় স্বজনের সাথে কত হৈ-হুল্লোড় করেছি। অথচ এইবার হাসপাতালের বেডে  বেঁচে থেকেও যেন মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছি। কি এক অদ্ভুত জীবন মানুষের। না পারছি কিছু খেতে না, পারছি ভালভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে।এভাবে বেঁচে থাকাটা কতটা যন্ত্রণার তা আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না। আর এই কষ্ট আমি বোঝাতেও পারবো না। কিন্তু  আমি তো এমন জীবন চাইনি। আর এভাবে বেঁচে থাকতে হবে সেটাও চাইনি। কি অপরাধ ছিল আমার, কেন পুলিশ আমার ওপর এইভাবে একেবারে কাছ থেকে গুলি চালালো? হাসপাতালের শয্যায় এই কথাগুলো অস্পষ্ট স্বরে বলছিলেন আন্দোলনে গুরুতর আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ।
বর্তমানে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন  অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সাত তলায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি গত ১৫ আগস্ট থেকে এখানে ভর্তি হন।  পেশায় প্রাইভেটকারচালক ছিলেন। গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের  গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
শনিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে নাক-মুখ উড়ে গেছে ২৩ বছর বয়সী এই তরুণের। সব সময় মুখ ঢেকে রাখেন কারণ তাকে যে কেউ  দেখলে আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা রয়েছে। ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু এগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বলা যায়, সেখানে বড় একটি গর্ত হয়ে আছে। কোন ধরনের খাবার খেতে পারেন না। নলের সাহায্যে নাক শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে । আর এক চোখ প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। আরেক চোখ কোনোভাবে টিকে থাকলেও আবছা দেখেন। তার এক পায়ে গুলি রয়ে গেছে।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান,  খোকনের মুখের ক্ষতস্থান কিছুটা সেরে উঠেছে। ভর্তি হওয়ার শুরুর দিকে কৃত্রিম শ্বাসনালি দিয়ে নিশ্বাস নিতে হতো। বর্তমানে কৃত্রিম শ্বাসনালি খুলে দেওয়া হয়েছে। আগে নল দিয়ে তাকে তরল খাবার দেওয়া হতো। এখন মুখের গর্ত দিয়ে তরল খাবার একটু খেতে পারছেন। শক্ত কোন খাবার খেতে পারেন না।  তবে তার অবস্থা এখনো খুব ক্রিটিক্যাল। কারণ  খুব কাছ থেকে  মুখে ছররা গুলি মারা হয়েছে। গুলিতে তাঁর মুখের একটি বড় অংশ হাড়সহ নষ্ট হয়ে গেছে। তার যে জটিল অবস্থা হয়েছে, দেশে এর চিকিৎসা সম্ভব নয়। বিদেশে নেওয়ার হলেও সেই আগের অবস্থা হয়তো ফিরে পাবে না। তবে কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। তাই তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তারা। এছাড়াও  বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক অধ্যাপক লুৎফর কাদের লেনিনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। তাদের তত্বাবধানেই  এখন চিকিৎসা চলছে।
জানা গেছে, শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় খোকনের বাড়ি। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। বাবা কৃষ্ণচন্দ্র বর্মণ একটি হাসপাতালে খাবার সরবরাহের কাজ করেন। মা শ্রীমতি রিনা রানী দাস গৃহিণী। বড় ভাই প্রাইভেট চালক খোকা চন্দ্র বর্মণের সাথে তারা মহাখালিতে থাকেন। কিন্তু ছোট ভাই শুভ চন্দ্র বর্মণকে নিয়ে খোকন নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডের সোনালী মার্কেট এলাকায় থাকেন।
তার পরিবাবের সদস্যরা জানান, ছাত্র-জনতার এক দফার আন্দোলনে সরকার পতনের দিন
অর্থাৎ গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন খোকন। পরে সেখান থেকে ছাত্ররা উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ওইদিন সন্ধ্যার দিকে ঢাকা ডেন্টালে নেওয়া হয়। তারপরে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আনা হয়।
কিভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সেইদিনের সেই বীভৎস ও রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেন খোকন। যদিও তার তার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মুখের গর্ত দিয়ে জিবের নড়াচড়া দেখলে বোঝা যায় কিছু একটা বলতে চান তিনি। তবুও অস্পষ্টভাবে  খোকন  বলেন, ৫ আগস্ট দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  পদত্যাগের খবর শুনে সবার মত আমিও মিছিলে যাই। আমাদের মিছিল শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী থানার আসলে পুলিশের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। তখন পুলিশ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। চোখের সামনে কত মানুষ যে গুলি খেয়ে আহত-নিহত হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। এক পর্যায়ে আমিও পুলিশের সামনে পড়ে যাই। এক পুলিশ সদস্য খুব কাছ থেকে আমার মুখের মধ্যে গুলি করে। তখন আমি মাটিতে পড়ে গিয়ে  চিৎকার করেছি আর হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছি। কিছুক্ষণ এইভাবেই ছিলাম। পরে আর মনে নেই। কে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি , কিভাবে আমার পরিবার খবর দেওয়া হয়েছে কিছুই জানিনা।
তিনি বলেন, বতমানে নিজের মুখ নিজেই দেখলে আতঁকে উঠি। যে কেউ আমাকে দেখলে নিশ্চিত ভয় পাবে। কিছু খেতে পারি না। কথা বলতে পারিনা, নিঃশ্বাস নিতে পারিনা। এইভাবে কি একটা মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কি জীবন ছিল আমার-কত স্বপ্ন ছিল, সবই শেষ হয়ে গেল। যেভাবে বেঁেচ আছি এটা কে তো বাঁচা বলে না। এই মরণ যন্ত্রণা আর সহ্য না।  বেঁচে থেকেও যেন মরে গেছি এমন মনে হয়।
বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা বিষয়ে দেরি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ  খোকন বলেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করে আহত হয়েছি। কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এখনো  দেরি হচ্ছে কেন। দ্রুত বিদেশ নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারসহ সকলের কাছে জোর দাবি জানাই।
হাসপাতালে খোকনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তার বড় ভাই খোকা চন্দ্র বর্মন সেদিনের ঘটনার একটা ভিডিও দেখান। ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত অবস্থায়  খোকন রাস্তায় পড়ে চিৎকার করছেন। তার পাশে পড়ে  আছে ছোট বাঁশের টুকরায় বাংলাদেশের পতাকা। আশ-পাশের  কয়েকজন চিৎকার করে বলছেন, ‘ও  আল্লাহ, তুমি দেহ, আল্লাগো… তুমি বিচার করো।’
খোকা বলেন, আহত হওয়ার পর একজন ছাত্র ফোন দিয়ে বলেন আপনার ভাই গুলিবিদ্ধ। দ্রুত হাসপাতালে আসেন।’কোন হাসপাতালে, সেটা বলে না। পরে সাইনবোর্ড এলাকায় খোঁজ শুরু করি। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ঢাকা মেডিকেল নিয়ে গেছে। পরে রাতে দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগে খুঁজে পাই।
তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। ইতিমধ্যে আমাদের ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সব টাকাই ধার-দেনা করা। যদিও আহত হওয়ার পর থেকে ছাত্র থেকে শুরু করে চিকিৎসক ও সরকারসহ অনেকেই সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এখন যে অবস্থা আছে সেই ব্যাপারে ডাক্তাররা বলেছেন, আমাদের দেশে আর  কোন চিকিৎসা নাই। তাই বিদেশে নিয়ে যেতে হবে। তাই সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে দ্রুত বিদেশ নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থার করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তার পরিবারের সদস্যরা জানান, খোকন আহত হওয়ার পর আর্থিকভাবে যে প্রতিষ্ঠান সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন এবং বিশেষ করে প্রথশে যে সকল ছাত্ররা  হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেছিলেন তাদেরকে এশবার হলেও তারা দেখতে চান এবং ধন্যবাদ জানাতে চান।
চিকিৎসকরা জানান, খোকনের  চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে  অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়া থেকে পজিটিভ রেসপন্স পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমে ৮ কোটি টাকা এবং পরে কমিয়ে ৪ কোটি টাকা খরচের কথা  জানানো হয়। আর রাশিয়ায় আরও অনেক কম খরচে পাঠানো যাবে (৪০ লাখ রুবল)। মুখের এই ধরনের সার্জারির সাকসেস রেটও রাশিয়ায় বেশি। তবে ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করছে বলেও জানান তারা।
চিকিৎসার সার্বিক বিষয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মৃদুল কান্তি সরকার  বলেন,  খোকনের যে ধরনের সার্জারি প্রয়োজন তা বাংলাদেশে হয় না। আর  সার্জারি করা হলেও আগের অবস্থায় আর ফিরে আসা সম্ভব না। তবে কার্যক্রম ও কর্মক্ষম যতটা সম্ভব যতটা করা যায়। নাক মুখ বানানো বিষয়ে আমাদের হাতে সুযোগ খুবই কম। কেন হবে না তার কারণ হলো হলো  মুখ পুনর্গঠনে  বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচার করতে হয়। আর এককার অপারেশন করার পর আরেকবার করা খুবই রিস্কি। অপারেশন করার সময় আশপাশের টিস্যু ব্যবহার করা হয়। আর একবার যে টিস্যু ব্যবহার হয়ে যায় সেই জায়গার জন্যেও টিস্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের পক্ষ থেকে  বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ করছি। তবে আমরা চাইলেও তো বিদেশে নেওয়া সম্ভব নয়। সেই দেশকেও তো চাইতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টাও তাকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে অন্তরিক। এখন বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া গুলোর কাজ চলছে।আশা করছি দ্রুতই নেওয়া হবে।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com