সারা বিশ্বজুড়ে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। অনেক দেশের মত বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বর্তমানে প্রতি চারজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, যা আগে ছিল প্রতি পাঁচজনে একজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে ১৩০ কোটি মানুষ (৩০-৭৯ বছর) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, যার বেশির ভাগ বাস করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। এর মধ্যে বাংলাদেশে অনুমিত উচ্চ রক্তচাপ রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। যাদের বয়স ৩০ থেকে ৭৯ বছর। এসব রোগীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ শনাক্তের বাইরে। যারা এই রোগে সম্পর্কে জানেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা যা অকালমৃত্যু ঘটায়। দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ। দেশের প্রাপ্ত বয়ষ্কদের মধ্যে এক চতুর্থাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটির নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না। রোগী বুঝতেই পারে না যে, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এজন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়।
তারা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণে শুধু হৃদরোগীর মৃত্যু বাড়ছে তা নয়। পঙ্গু্ত্েবর প্রধান তিনটি কারণে একটি উচ্চ রক্তচাপ। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এ থেকে হৃদ্রোগ, হার্ট ফেইলিউর, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধত্ব, স্ট্রোকসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব।
এমন বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ । এ রোগের বিস্তার রোধ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ১৭ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় । এ বছরের প্রতিপাদ্য: ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে,অসংক্রমক রোগের প্রভাবে বিশ্বে প্রতি বছর ৪১ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, যা বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৪ শতাংশ। নিয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই মৃত্যুহার আরো বেশি, প্রায় ৭৭ শতাংশ। বাংলাদেশেও অসংক্রমক রোগের প্রকোপ ভয়াবহ। বছরে প্রায় ৫,৫৭,২০০ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৭১ শতাংশ এবং যার ১৯ শতাংশই অকাল মৃত্যু। আবার ২০২৩ সালে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক প্রথম বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডব্লিউএইচও। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩০-৭৯ বছর বয়সি জনগোষ্ঠির ৩৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এরমধ্যে (৩৪ শতাংশ পুরুষ, ৩২ শতাংশ নারী)। বিগত ৩০ বছরে (১৯৯০-২০১৯) মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ কোটি থেকে বেড়ে ১৩০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
আর গ্লোবাল রিপোর্ট অন হাইপারটেনশন, ডব্লিউএইচও সবশেষে তথ্য ২০২৩ অনুসারে, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে অক্রাান্তদের (৩০-৭৯ বছর বয়সি) অর্ধেকই
(৫৫ শতাংশ পুরুষ, ৪৬ শতাংশ নারী) জানে না যে তাদের উচ্চ
রক্তচাপ রয়েছে। আক্রন্তদের মধে হার খুবই কম। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত শনাক্তকৃতদের রোগীদের মধ্যে চিকিৎসা নেন মাত্র ৩৮ শতাংশ (৩৪ শতাংশ পুরুষ, ৪২ শতাংশ নারী)। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে
চিকিৎসকরা জানান, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ এবং উপসর্গথাকে না, অর্থাৎ রোগী বুঝতেই পারে না যে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। রক্তচাপের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূতি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অত্যধিক উচ্চ
রক্তচাপে ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশী কম্পনের কারণ হতে পারে।অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সাথে অতিরিক্ত লবণ(সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন এবং বায়ু দূষণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন উচ্চ রক্তচাপের
ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সাথে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
জানা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ওষুধ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট-এর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মো. এনামুল হক বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে যে উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা ও ওষুধে ১ টাকা বিনিয়োগ করলে সামগ্রিকভাবে ১৮ টাকার সুফল পাওয়া যায়। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষভাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হলে উচ্চ রক্তচাপজনিত অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার,
তিনি বলেন, উচ্চ রক্তচাপের ভয়াবহতার বিষয়ে মানুষকে সতেচন হবে। এজন্য কমিউনিটি পর্যায়ে মানুষের সম্পৃত্ততা বাড়াতে হবে। উচ্চ রক্ত নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যে সকল রোগী আক্রান্ত হচ্ছে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি স্কিনিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।