নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। দেশে বর্তমানে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ লোক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে ভুগছে। প্রতি ১ হাজারে আক্রান্ত হচ্ছে অন্তত ১০ জন।
আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। প্রতি হাজারে গড়ে ৩ থেকে ৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন।
স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ, হার্টের নয়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অথবা হঠাৎ রক্ত সঞ্চালন কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে স্ট্রোক হয়ে থাকে। বিশ্বে পঙ্গুত্বের প্রধান এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। অথচ অসংক্রামক এই ব্যাধিটি অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) সকাল ৯টায় বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মিলটন হলে বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্সের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ২৯ অক্টোবর স্ট্রোক দিবস পালন করা হয়। ‘একত্রে আমরা স্ট্রোকের চেয়ে বড়’–এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবার পালিত হলো দিবসটি।
এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে স্ট্রোক কি তা জানা এবং বোঝা স্ট্রোক কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর পরিপূর্ণ যত্ন ও উপযুক্ত চিকিৎসা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সারা বিশ্বে প্রতি ছয়জনে একজন এই রোগের ঝুঁকিতে আছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫০ লক্ষ লোক এ রোগে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ৬০ লাখ লোক মারা যান এবং ৫০ লাখ লোক আজীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে পরেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান, সোসাইটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মওদুদুল হক বলেন, ‘স্ট্রোক প্রধানত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। মস্তিষ্কে হঠাৎ রক্ত সঞ্চালন কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের এই অংশে কার্যক্ষমতা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে কার্যক্ষমতা স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়া, কথা বলতে না পারা, মুখ বাঁকা হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনিতে আক্রান্ত হওয়া এমন কী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। একে ইস্কেমিক স্ট্রোক বলা হয়।’
‘অন্য আরেকরকম স্ট্রোক হয়। যেখানে মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। সাধারণভাবে যা ব্রেন হেমারেজ নামে পরিচিত। এ রকম স্ট্রোকের উপসর্গ সাধারণত আরও ভয়াবহ হয়। এ ছাড়াও মস্তিষ্কের রক্তনালীর অন্যান্য রোগ থাকার কারণে রক্তপাত হয়ে স্ট্রোক হয়। রক্তনালীর বিশেষ অংশ ফুলে গিয়ে ফেটে যাওয়া, ধমনী ও শিরার অস্বাভাবিকতা থেকেও স্ট্রোক হতে পারে’–যোগ করেন তিনি।
সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্সের সদস্য সচিব ডা. নুরুজ্জামান খান বলেন, ‘দেশের এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জারি হচ্ছে, যেখানে কাঁটাছেড়া হয় না, বরং রক্তনালীর মধ্য দিয়েই এ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সময়ে এই প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। অন্যান্য দেশে নিউরোসার্জারির যেসব অস্ত্রোপচার হচ্ছে, আমরাও বিশ্বমানের সব করছি। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বহু সেন্টারে এটি হচ্ছে। এমনকি বিএসএমএমইউতে এটি হচ্ছে।’
বিএসএমএমইউ প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অল্প বয়সীদের স্ট্রোকের অন্যতম কারণ ড্রাগ। সম্প্রতি তরুণ সমাজ একটি সুন্দর বিপ্লব করে নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছে। নতুন এ বাংলাদেশে যারা তরুণদের নেশা জাতীয় দ্রব্য তুলে দিচ্ছে, তাদের কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব বলেন, দেশে নিউরোসার্জারির যে কোনো অপারেশন করা সম্ভব। বাংলাদেশে কয়েকশ’ সুদক্ষ নিউরোসার্জন রয়েছেন, যারা বিশ্বমানের চিকিৎসা দিতে সক্ষম। ভারত, সিঙ্গাপুর, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় যে সার্জারি হয়, যেভাবে করা হয়; আমাদের দেশেও তাঁরা একই প্রক্রিয়ায় অস্ত্রোপচার করেন
সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেলেও যে কোন বয়সেই তা হতে পারে। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়।
আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কম। ফাস্টফুডে আসক্তদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও তরুণদের অনেকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্ট্রোক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।
স্ট্রোকের এই ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে এবং মানুষকে সচেতন করতে ইউরোপিয়ান স্ট্রোক অর্গানাইজেশন ১৯৯০ সালে সর্বপ্রথম স্ট্রোক দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়; কিন্তু অর্থসংকটে থাকায় তারা শুধুমাত্র ইউরোপের মধ্যেই মে মাসের ১০ তারিখে এ দিবসটি পালন করে।
২০০৪ সালে কানাডার ভ্যানকুভারে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক কংগ্রেসে প্রথম বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করার কর্মসূচি চালু করা হয়।
২০০৪ সালে কানাডার ভ্যানকুভারে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক কংগ্রেসে প্রথম বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করার কর্মসূচি চালু করা হয়।
২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রোক সোসাইটি এবং ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক ফেডারেশন একত্রিত হয়ে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন তৈরি করেন যারা পরে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালনের দায়িত্ব নেন।
২০০৭ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশানের অধীনে প্রতিবছর স্ট্রোক সচেতনতা বাড়াতে ‘বিশ্ব স্ট্রোক দিবস’ পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়।