নিজস্ব প্রতিবেদ।।
সারাদেশজুড়ে বর্তমানে এক আলোচিত নাম রাসেলস্ ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া কিংবা উলুবোড়া সাপ। রাসেলস ভাইপার কামড়ালেই ‘মৃত্যু নিশ্চিতসহ নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বলা হচ্ছে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপের একটি। আবার এই সাপ মারলেই পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের দশটি বিষধর সাপের মধ্যেও নেই রাসেল’স ভাইপারের নাম। দেশের ২৭ জেলায় বহুল আলোচিত রাসেল’স ভাইপার পাওয়া গেছে। এর মানে এই নয় যে, এসব এলাকার মানুষ ঘর থেকে বের হবে না। এই সাপ নিয়ে অনেক বেশি মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যার কোন ভিত্তি নেই। এই সাপ কখনও তেড়ে এসে মানুষকে কামড়ায় না। সে বিপদের ঝুঁকি দেখলেই শুধু কামড় দেয়। এ সাপের দংশনে ৭০ শতাংশ রোগী সুস্থ হচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী দেরিতে হাসপাতালে আসা। তাই রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন হলে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন কর্তৃক আয়োজিত ‘রাসেল’স ভাইপার : ভয় বনাম ফ্যাক্ট’ শীর্ষক সেমিনারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন।
আলোচকরা বলেন, ২০১৩ সালে প্রথববার রাসেলস্ ভাইপার সাপটির কামড়ে রোগী পাওয়া যায়। আর দেশে বর্তমানে ৬৬৫ জন মানুষকে প্রতিদিন কুকুরে কামড়ায়। ডুবেও অনেক সংখ্যক মানুষ মারা যায়। কিন্তু রাসেল’স ভাইপারে কামড়ের সংখ্যা আরও অনেক কম। অথচ সাপের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘোষণা করা হয়েছে। এটি করা যাবে না। কারণ সাপ ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স রক্ষা করে। সাপের বিষ ওষুধ তৈরির একটি উপাদান। মানবসৃষ্ট কারণের সাপ তার বাসস্থান থেকে লোকালয়ে আসছে। রাসেল ভাইপার নিয়ে অসংখ্য মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে আতঙ্ক তৈরি না করে সচেতন হবে। ভয় তৈরি করা যাবে না।
তারা বলেন, বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত এন্টিভেনমের মজুদ রয়েছে এবং উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত তা পৌঁছানো হয়েছে। একইসঙ্গে দেশে এর এন্টিভেনম তৈরি কাজ চলমান আছে।
রাসেল’স ভাইপার নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবাই নিরলসভাবে কাজ করছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সারা দেশে চিকিৎসক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কর্মী, বিশেষজ্ঞরা এমনভাবে কাজ করছেন। রাসেল’স ভাইপারের এন্টিভেনম বাংলাদেশের প্রত্যেক হাসপাতালে আছে। দেশে পর্যাপ্ত এন্টিভেনমের মজুদ রয়েছে। অথচ
বলা হচ্ছে ভ্যাকসিন নাই, তাই রোগী মারা যাচ্ছে। দয়া করে এই ধরনের ভুল তথ্য কেউ দিবেন না। কারণ ভুল তথ্য দিলে মানুষ আতঙ্কিত হয়।
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, রাসেল’স ভাইপার নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, আমাদের এন্টিভেনমের সংকট নেই। যদি নাও থাকে আমরা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো। তাই আসুন, আমরা একসাথে সচেতন হই। সচেতনতার কোন বিকল্প নাই। সবাই একসাথে সচেতন হলে আমরা বর্তমানে যে ক্রাইসিস সেটা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারব।
চিকিৎসকদের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাকালে আমরা শুনেছিলাম, ঢাকার রাস্তায় মানুষের লাশ পড়ে থাকবে। চিকিৎসকদের কল্যাণে তা হয়নি। এবারও সবার চেষ্টায় এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করতে পারবো।
সর্পদংশনে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংসদ সদস্যদের অনেক হ্যান্ডস আছে, মেম্বার আছে, চেয়ারম্যান আছে। রোগী হাসপাতালে আনার দায়িত্ব যদি আপনারা নেন এবং দ্রুত চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে আসেন। তাহলে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে। চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা হচ্ছে। রোগী তো যথাসময়ে আনতে হবে। সেটা তো আর চিকিৎসকরা পারবে না। কিন্তু এই যে যত দ্রুত নিয়ে আসা যায় তাহলে কিন্তু আমারা রোগীটা বাঁচাতে পারি।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা বলেন, বাংলাদেশে সবাই ডাক্তার। এটি একটি বড় সমস্যা। আমাদের এখানে যেকোনো রোগে মানুষ নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ওষুধ খায়। এমনকি এন্টিবায়োটিকও খায়। সাপের কামড়ে ওঝাদের কাছে না গিয়ে যেকোনো রোগে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সাপের বিষয়ে আমরা সচেতনা তৈরির চেষ্টা করছি। এই বিষয়ে গণমাধ্যনের সহযোগিতা চাই।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. টিটো মিয়া বলেন, সাপে কাটা রোগী যদি হাসপাতালে এসে মৃত্যুবরণ করে এর দায় আমাদের। আমাদের প্রতিটি হাসপাতালে এন্টিভেনম পৌঁছানো হয়েছে। আমাদের চিকিৎসকরা এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত। তবে ওঝাসহ নানা কারণে রোগী হাসপাতালে আসতে দেরি করায় মৃত্যু বাড়ে। দেরিতে হাসপাতালে আসায় রোগীরা অন্তত ক্রিটিক্যাল অবস্থায় চলে যায়। ওই অবস্থায় তাদের ইনটেনসিভ কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজন। হাসপাতালে এই ক্রিটিক্যাল রোগীদের মৃত্যু অনেকটার রোধ করা সম্ভব যদি ইনটেনসিভ সেবা নিশ্চিত করা যায়।
সেমিনারে বৈজ্ঞানিক সেশনে বক্তা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আবু রেজা, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন মো. মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ রাসেল’স ভাইপার সাপ এবং এন্টিভেনম নিয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নূরুল হক, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বক্তব্য রাখেন।