‘বর্জ্যের স্তূপ ও সিসা দূষণ ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে মস্তিষ্কের বিকাশে’

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

শহরের  চারপাশের বর্জ্যের স্তূপ মানুষের পরিপাকতন্ত্র, পুষ্টি ও মস্তিষ্কের বিকাশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। একইভাবে ভূমিকা রাখছে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সিসা দূষণ। পরিবেশগত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।

 আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) আয়োজিত পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানের আলোচকদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে।

‘প্লাস্টিক দূষণ রুখে দাও’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইসিডিডিআর,বির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনসংখ্যা অধ্যয়ন বিভাগের এনভাইরনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ রিসার্চ গ্রুপ। তিন শতাধিক গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উন্নয়ন সহযোগী, সরকারি কর্মকর্তা ও পরিবেশকর্মী এতে অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, আমরা যে পরিবেশগত কাজগুলো করি, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, নগরের চারপাশে যেসব বর্জ্যের স্তূপ দেখা যায়, কিংবা যে সিসা দূষণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে—এসব মানুষের পরিপাকতন্ত্র, পুষ্টি ও মস্তিষ্কের বিকাশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। এ সময় এই পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের উপর জোর দেন ড. তাহমিদ আহমেদ।

এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ প্রোগ্রামের প্রধান ও প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. মো. মাহবুবুর রহমান আইসিডিডিআর,বির পরিবেশ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণা এবং কার্যকর উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের অপরিচালিত বর্জ্যের স্তূপে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিচ্ছে, যা মানুষের অন্ত্রের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং অপুষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আলোচনায় প্লাস্টিক দূষণকে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, ২০০৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৪৩০ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যক্তিগত, সামাজিক, শিল্প এবং নীতিগত পর্যায়ে নানা ধরনের পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয় অনুষ্ঠানে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিহার এবং প্রাকৃতিক তন্তুর পোশাক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। একই সাথে সামাজিকভাবে সংগঠিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং আলাদা করে বর্জ্য সংগ্রহের উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর শিল্পখাতে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং ও পরিশোধন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন এবং সরকারিভাবে কঠোর আইন প্রয়োগ ও নির্মাতাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয় অনুষ্ঠানে।

সিসা দূষণের ভয়াবহতাও আলোচনায় উঠে আসে। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৩.৬ কোটি শিশু সিসা দ্বারা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। হলুদ মরিচে সিসা ক্রোমেটের ব্যবহার এই দূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর সরকার এর আমদানি নিষিদ্ধ করে। এর ফলে হলুদ মরিচে সিসা দূষণের হার ২৭ শতাংশ থেকে ০ শতাংশে নেমে আসে। তবে সমস্যা এখানেই শেষ নয়। আলোচকরা বলেন, সিসা-দূষণমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে হলে বাতাস, পানি ও মাটি থেকে সিসা নির্মূল, লীড-অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং নিয়ন্ত্রণ, ভোক্তা পণ্য থেকে সিসা অপসারণ, শিল্প ও যানবাহনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্যপণ্যে নিয়মিত সিসা পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উদ্ভাবনের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশের ইটভাটাগুলোর দূষণ প্রসঙ্গে বলা হয়, এসব থেকে বছরে ১১ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং রাজধানী ঢাকার পিএম২.৫ দূষণের ৫৮ শতাংশ নিঃসরিত হয়।

আলোচনায় তুলে ধরা হয়, সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা ব্যবহারে ২৩ শতাংশ এবং কার্বন ও পিএম২.৫ নিঃসরণে ২০ শতাংশ হ্রাস অর্জন সম্ভব হয়েছে। হাসপাতালের তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তাও জোর দিয়ে বলা হয়। একই সঙ্গে তীব্র গরমে কৃষি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়েও আলোচনা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীষ্মে ১৫ শতাংশ কৃষি শ্রমিক হিট এক্সহসশনে (অতিরিক্ত গরমে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া) এবং ১০ শতাংশ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এই সমস্যা মোকাবেলায় ছায়া নির্ভর অবকাঠামো, প্রাকৃতিক সমাধান এবং সময়ভেদে কাজ করার কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, আইসিডিডিআর,বির গবেষণা আমাদের নীতিনির্ধারণে সহায়তা করছে। আমরা যদি সবাই মিলে কাজ করি, তবে অবশ্যই একটি সবুজ ও টেকসই বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সরকারের প্রতিশ্রুতি দৃঢ়। আইসিডিডিআর,বির মতো প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবনী গবেষণাই আমাদের নীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। প্রতিটি নাগরিকের ছোট ছোট কাজই বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

আইসিডিডিআর,বির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনসংখ্যা অধ্যয়ন বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারাহ সালওয়ে সমাপনী বক্তব্য দেন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট) ডা. মো.  জয়নাল আবেদীন টিটো।

অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল একটি প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা উপস্থাপনা, যেখানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত সেরা তিনটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারহানা মুস্তারিন তাঁর ‘নগর তাপ প্রশমন: ঢাকায় তাপদাহ প্রতিরোধে প্রাকৃতিক সমাধানের কার্যকারিতা’ শীর্ষক গবেষণায় শহরের তাপদাহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ছাদবাগান ও গাছপালা সমৃদ্ধ রাস্তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাবিহা সুলতানা নুহা তাঁর ‘বর্জ্য থেকে সম্পদ: খাদ্যবর্জ্য দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব কাটলারি’ গবেষণায় কলার খোসা, ধানের ছোঁড়া ও কাঁঠালের বীজ দিয়ে তৈরি খাওয়ার উপযোগী, জৈব ও টেকসই কাটলারির ধারণা দেন। এ ছাড়া ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শরাফ নওয়ার তাঁর গবেষণায় ঢাকার ল্যান্ডফিল থেকে সংগ্রহকৃত স্যুডোমোনাস (Pseudomonas) জীবাণুর মাধ্যমে প্লাস্টিক জৈবভাবে অপসারণের সক্ষমতা তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানের শেষাংশে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়। পোস্টার ও মৌখিক গবেষণা উপস্থাপনা, ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত অনুপ্রেরণাদায়ী উদ্যোগের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণকারীদের পুরস্কৃত করা হয়। পোস্টার উপস্থাপনায় রুবিনূর ইসলাম সেরা নির্বাচিত হন। গবেষণা উপস্থাপনায় শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে পুরস্কৃত হন শরাফ নওয়ার। ১,১০০-এর বেশি ছবি থেকে ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও সমাধান নিয়ে ধারণকৃত ১০টি ছবি অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়। এখান থেকে সেরা তিনজনকে পুরষ্কৃত করা হয়। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে পরিবেশ-সংক্রান্ত অনুপ্রেরণাদায়ী উদ্যোগের জন্যও বিশেষ স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রদান করা হয় ।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com