আল আমিনের মতো পা না কাটা না পড়লেও পা হারানোর শষ্কা নিয়ে হাসপাতালে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছেন আরও দুই শিক্ষার্থী। তারা হলেন পটুয়াখালীর ৮ শ্রেণীর ছাত্র মো: হাসান এবং ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার উপজেলার ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী মো. শাহীন। তাদের তিনজনই অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং আন্দোলনে সময় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে চিকিৎসার ব্যয়Ñভার বহন করতে নি:স্ব হয়ে পড়েছেন তাদের পুরো পরিবার। এমনকি তাদের পড়াশোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে তারা পঙ্গুত্ব বরণ করলেও জীবনের কাছে হার মানতে রাজি নয়। সুস্থ হয়ে নব উদ্যোমে- নতুন করে বাঁচতে চান এবং পরিবারের হাল ধরতে চান এমনই দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা জানান তিনজনই।
পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পা হারানো আল আমিনের বাবা সিএনজি চালক বাবুল হোসেন রাজধানীতে সিএসজি চালায়। স্ত্রীকে থাকেন বাড্ডা এলাকায়। কিন্তু আল আমিন গ্রামের বাড়িতে দাদার সাথে আমিনপুরে। সেখানের স্থানীয় একটি স্কুলে এবার নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। আন্দোলনের শুরুর দিকে ঢাকায় বাবা-মার কাছে এসেছিলেন। পরে আন্দোলন শুরু হলে আল-আমিনও জড়িয়ে যান।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মাসব্যাপী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের বিজয় দিনে ৫ আগস্ট দুপুরে ছাত্র-জনতার সাথে মেরুল বাড্ডা এলাকায় পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে যান। কিছুদূর এগুতেই তাদের মিছিল পুলিশের সামনে পড়ে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পরে এক পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। পুলিশও এলোপাথারি গুলি বর্ষণ ও টিয়ারশ্যাল নিক্ষেপ করে। পুলিশের ছোড়া গুলিতে পা, বুক, হাত, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয় অনেকেই। তাদের মধ্যে আল আমিনও গুলিবিদ্ধ হন। সেখান ছাত্ররা উদ্ধার করে প্রথমে বাড্ডা এলাকায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করেন। পরে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর পায়ের মধ্যে গুলি লাগার কারণে মাংশ পচন ধরা শুরু করে। পরে চিকিৎসকরা আল আমিনের বাম পা কেটে ফেলেন। এর পর থেকে সেখানেই চিকিৎসা চলছে তার। এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় তাদের লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। সব টাকাই ধার দেনা করা।
আল আমিন আমিন বলেন, আমি ৫ তারিখ সকাল থেকেই মেরুল -বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। আমি ঘটনাস্থলে অনেকেই মারা যেতে দেখেছি। তাদের অনেককেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।কিন্তু আমি বেঁচে গেছি। প্রথমে পা কাটার পর খুব খারাপ লাগতো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো আমার পা নেই। কিন্তু এখন লাগে না। আমি সুস্থ হয়ে আবার স্কুলে যেতে চাই। আমরা গরীব মানুষ। মা-বাব আমার জন্য খুব কষ্ট করছে। আমি পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই এবং বাবা মার স্বপ্ন পূরণ চাই।
তার বাবা বাবুল হোসেন বলেন, আমার ছেলে পা হারিয়েছে।তবু শুকরিয়া। মারা যায়নি। প্রথমদিনই ২০ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। কিন্তু আমি এক ব্যাগই যোগাড় করতে পারি নাই। সবই ছাত্ররা ও বিভিন্ন মানুষে দিয়েছে। তবুও আমার ছেলেটার যে এই অবস্থা করেছে আমি তার বিচার চাই। কেন গুলি করে পঙ্গু করে দিলো।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তার মা আছিয়া বেগম বলেন, ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে বুক ফেটে যায়। চিকিৎসায় প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আমার যা কিছু ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। জানিনা ভবিষ্যতে কিভাবে ছেলেকে সুস্থ করে তুলবো।
পুলিশ সরাসরি অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে এমন অভিযোগ করে গুরুতর আহত মো: হাসান জানান, আমি ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর মিছিল নিয়ে বের হই। পরে জুরাইন এলাকা আসলে পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমার ডান পায়ে পুলিশ গুলি করে। শুধু আমাকে নয় আমার সাথে অনেকেই সরাসরি গুলি করে এবং আমার গুলি বের হয়ে আরেকজনের মধ্যে মাথায় লাগে। সেও গুরুতর হয়। আমি জানিনা সে কি এখন বেঁচে আছে না মরে গেছে। তবে আমি অনেক কষ্টে আছি। সারা শরীরে গুলির ক্ষত রয়েছে। পায়ের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা। পায়ে লোহার রড লাগানো। মনে হয় মরে যাওয়া এর চেয়ে ভাল। হুইল চেয়ার আমার ঠিকানা। কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারি না। দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। জানিনা সুস্থ হতে পারবো কি-না । নাকি আবার পা-টা কেটে ফেলতে হয়।
তবে জীবন যুদ্ধে হারতে রাজি নয় বলেও জানান তিনি। নতুন করে লড়াই করে রিকসা চালক বাবা দু:খ ঘোচাতে চান তিনি।
তার বাবা আ: মজিদ বলেন, আমার ছেলেকে এমনভাবে গুলি করেছে যে হাঁটুর নিচে হাড় ভেঙ্গে ৬ ইঞ্চি গর্ত হয়ে গেছে। সারাক্ষণ পুঁজ পড়ে। খুব চিন্তুা আছি ছেলের পা টা যেন কাটতে হয়।
ছেলেকে এখানে ভর্তি হওয়ার পর তার আয় রোজগার সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ তিনি বলেন, আমি রিকসা চালিয়ে দিন আনি দিন খাই। ছেলের খরচ চিকিৎসার যোগাতে সব কিছু বিক্রি করেছি। ছেলের সহায়তার করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
সন্তানের করুণ অবস্থা দেখে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা হাসি বেগম। তিনি বলেন, জানি না আমার ছেলে আদৌ সুস্থ হবে কি-না। আর সুস্থ হলেও ঠিকভাবে হাঁটতে পারবে কি? আর সুস্থ হলেও কিভাবে পড়ালেখা করবে। আর কেমন ওষুধের টাকা যোগাড় করবো সেই দুচিন্তায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করি আমি।
গত ৫ আগস্ট ঢাকার উত্তরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মো: শাহীন। পরিবারের সদস্যরা জানায়, শাহীনরা দুই ভাই। তারা দুইনই দাদার বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার স্থানীয় এক স্কুলে পড়াশোনা করে। আর বাবা আ. জব্বার প্যারালাইসিসের রোগী হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী। তার মা শিউলি বেগম উত্তরা এলাকায় মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার এবং তাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালায়। আন্দোলনের মাঝখানে মা-বাবা দেখতে ঢাকায় আসেন শাহীন। পরে গণঅভ্যুত্থানের দিন শাহীনের বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
আহত হওয়ার পরে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরলেও কোন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন শাহীন।
তিনি বলেন, প্রথমে চিকিৎসা নিলে আজকে আমি আরও ভাল থাকতাম। আমার পায়ের অবস্থা এত খারাপ হতো। তবুও বেঁচে আছি। আমার সাথের একজনের বুকে গুলি লাগে, আরেকজনের শরীরে বেশ কয়েকটা গুলি লাগে আমার সামনেই। আমার পায়ে যখন গুলি লাগে তখন আমি পড়ে যাই। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।
তিনি বলেন, আমরা গরীব মানুষ। খুব করে বড় হচ্ছি। আমার জন্য আমার মা অনেক কষ্ট করছে। জানিনা পা কি কেটে ফেলতে হবে। ডাক্তাররা বলেছে, আরেকটি অপারেশন হবে, সেটার পর জানা যাবে ভালো হবে কি-না। তবে যত কষ্টই হোক, সুস্থ হয়ে মায়ের কষ্ট এবং বাবার স্বপ্নই পূরণ করতে চাই।
শাহীনের পাশেই বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন তার দাদী লাইলি বেগম। তিনি বলেন, ছোট থেকেই ওরা দুই ভাই আমার কাছে থাকে । আমিই অনেক কষ্টে লালন পালন করে বড় করছি। কখন ভাবি নাই। এই অবস্থায় নাতিতে দেখতে পাবো। আমার গরীব মানুষ। তার মায়ের যৎসামান্য আয়ে সংসারে টানাটানি করে সংসার চলে। এখন তার মা চিকিৎসার টাকা জোগাড় করব না কাজে যাবে। আর এভাবে আর কত চালাবেন।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত শাহীনের চিকিৎসায় ৭০/৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবই ধার-দেনা ও আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য করা টাকা। তাই আমার নাতিকে যারা পঙ্গু করছে, বর্তমান সরকারের কাছে বিচার চাই এবং আর্থিক সহায়তা চাই।