নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ঢাকার আশুলিয়ার তের মাসের শিশু আরবি। জন্মের ৬ মাস বয়স থেকে প্রথমে ঠান্ডাজনিত সমস্যা শুরু হয়। আর সেই ঠান্ডা থেকেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে তা ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দুই মাস ধরে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে চিকিৎসা চলছে বলে জানান তার মা সুমাইয়া আকতার। তিনি জানান, আমার বাচ্চার নিউমোনিয়ার টিকা দিয়েছে। তারপরও সেই ৬ মাস বয়স থেকে কাশি-জ্বর ঠান্ডা প্রায়ই সময় লেগেই থাকতো। সব সময় চিকিৎসকের কাছে দৌড়াতে হয়। এর আগে বাচ্চাকে এখানে এক মাসের মত ভর্তি ছিলাম। তার আগেও কয়েকবার অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। প্রতিদিনই ওষুধ লাগছে হাজার টাকা।মেয়ের চিকিৎসার পিছনে আমার জমানো টাকা জমি-জমা গহনা যা ছিল সব শেষ হয়ে হয়ে গেছে। এখন ধার দেনা করে কোনরকমভাবে খরচ যোগাড় করছি। জানিনা এভাবে আর কতদিন চালাতে পারবো। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, টাকা খরচ করেছি তাতে কষ্ট নেই কিন্তু মেয়েটার সুস্থ হচ্ছে না এটাই সবচেয়ে বড় দূ:খ।
একই অবস্থার কথা জানালেন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আরেক শিশু আফিফার বাবা জনি মিয়া। তিনি জানান, আমার বাচ্চা বয়স সাড়ে চার বছর। টিকা নেওয়ার পরও দুই বছর বয়স থেকেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এক পর্যায়ে হার্টের দুটি ছিদ্র ধরা পড়ে। প্রথমে যশোরে পরে এম আর খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। এই হাসপাতালে গত ১৭ দিন ধরে ভর্তি রয়েছি। কিছুদিন আগেও দেড়মাস ভর্তি ছিলাম। গত দুই বছরে কমপক্ষে আমার ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন ওষুধপত্রসহ হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আমরা তো গরিব মানুষ। এত টাকা পাব কই? কীভাবে ওষুধ খাব, আর কীভাবেই বা সংসার চলবে। আমার বাচ্চাকে যে দুধ কিনে খাওয়াব সে টাকার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে।
শুধু এই রোগীর পরিবার নয় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাত তলায় নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া প্রায় সর রোগীরই একই অবস্থা। কেউ এক মাস, কেউবা দুইমাস কিংবা তার চেয়ে বেশি দিন ধরে তাদের বাচ্চাকে নিয়ে ভর্তি রয়েছে। আবার কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরছেন। তাতে করে অনেকের পরিবার চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতায় চিকিৎসা করাতে পারছে না অনেকেই। টাকা অভাবে কিনতে পারছে না ওষুধ। আর্থিক অনটনের কারণে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবারগুলো।
যদিও দেশে কত শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে এ নিয়ে সুনিদিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলােেশ – আইসিডিডিআরবি সবশের্ষ তথ্য মতে, দেশে বছরে মারা যাচ্ছে ২৪ হাজার শিশু। ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্ব্যাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) তথ্য বলছে, ২০১১ সালে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১ হাজার জীবিত-জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে ১১ দশমিক ৭ শিশু মারা যেত নিউমোনিয়াতে। যা ২০১৭-২০১৮ সালে কমে হয় ৮.০। এরপর সর্বশেষ ২০২২ সালে হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। কিন্তু নিউমোনিয়া টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্তের হার কমানো যাচ্ছে না। কারণ হলো নতুন টিকার না থাকা, বায়ুর মান অবনতি। আবদ্ধ ঘরে রান্না ধোয়া। গত এক দশ আগেও এ রোগে আক্রান্তের মূল কারণ ছিল ‘নিউমোকক্কাল ও হিমোফিলাস’ ভাইরাস। বর্তমানে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ‘রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস’ দ্বারা।
তারা বলছেন, নিউমোনিয়া কোন জীবাণু দ্বারা হচ্ছে সেটির ৫০ শতাংশই এখনো অজানা। সেটি কি ভাইরাসের মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে তা জানা নেই। এটি জানার উপায় আছে, কিন্তু ইচ্ছা নেই। এতে কয়েক বছর ধরে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি থেমে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস।এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘আসুন, নিউমোনিয়া বন্ধ করার লড়াইয়ে সক্রিয় সহযোগী হই’।
চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফুসফুসের এক ধরনের ইনফেকশন বা প্রদাহ হলো নিউমোনিয়া। যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস অথবা পরজীবীর কারণে হতে পারে। প্রাথমিকভাবে ফুসফুসের বায়ুথলি অ্যালভিওলিতে (ফুসফুসের মধ্যে থাকা আণুবীক্ষণিক ঝিল্লি, যা অক্সিজেন শোষণ করে) বেশ জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় এতে তরল অথবা পুঁজ জমে যায়। তখন কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা অথবা পুঁজ, উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হতে পারে। তবে ।
তারা বলেন, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর এই তিনটি হলো নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে জ্বর থাকতে পারে ১০০-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তারও বেশি। আর মাত্রা একটু বেড়ে গেলে শিশুর বুকের খাঁচা (পাঁজরের নিচের অংশ) দেবে যেতে পারে। । তখন শিশুটি দ্রুত শ্বাস নেয়। দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের মিনিটে ৬০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নিতে দেখা যায়। দুই মাস থেকে ১২ মাস বয়সী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মিনিটে ৫০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নেয় এবং এক বছরের বড় শিশু ৪০ বার বা তার চেয়ে বেশিবার শ্বাস নেয়।এ ছাড়া নিঃশ্বাসের সময় বুকে ব্যথা, ঘাম, চুপচাপ থাকা, খাবারে অরুচি, ক্ষুধামান্দ্য, পেট ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণও থাকতে পারে। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে খিঁচুনিও হতে পারে। রক্ত পরীক্ষা ও বুকের এক্স-রে করলে বোঝা যাবে তার নিউমোনিয়া হয়েছে কি না।
এ প্রসঙ্গে আইডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ড. আহমদ এহসানুর রহমান বলেন, নিউমোনিয়া যে উপায়ে আমরা কমাতে পারি এর মধ্যে একটা হলো টিকা। রোগটি প্রতিরোধে সরকারের ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে বিসিজি, পিসিভি (নিউমোকক্কাল কনজোগেইট ভ্যাক্সিন), হিব (হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েনজি টাইপ বি ব্যাকটেরিয়া) ভ্যাকসিন বা টিকা হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে নিউমোনিয়া আক্রান্ত বেশি হচ্ছে রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল- আরএসভি ভাইরাস দ্বারা। যার টিকা এখনো ইপিআই’র অন্তভুক্ত হয়নি। বিশ্বে এ টিকার গবেষণা পরিক্ষা-নিরিক্ষা শেষ পর্যায়ে চলছে।
তিনি বলেন, নিউমোনিয়া কম হয় যখন বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। কিন্ত বিগত কয়েক বছরে ঢাকা শহরে উত্তর- উত্তর আরো খারাপ হয়েছে। এই সময়ে এমন হয়নি ছোট বড় কোন শহরের বাতাস উন্নত হয়েছে। আর বায়ুর মান উন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের কোন দৃশ্যমান পক্ষেপ নেই। এছাড়া জ্বালানি ধোঁয়া, প্রান্তিক জনগোষ্ঠি গৃহস্থালিক রান্নাঘর থেকে বায়ুর দূষনের মাত্র কমিয়ে আনা যাচ্ছে না।
ড. এহসানুর রহমান বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া একশ’টি শিশুর মধ্যে পাঁচটি শিশুর অক্সিজেন দেওয়ার তথ্য সঠিক হয়নি। শিশুকে অক্সিজেন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। অথচ দেখা গেছে, শিশুদের অক্সিজেন লেবেল সঠিকভাবে মাপা হয়না, কোন ডকুমেন্টস ছাড়াই চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো শিশুদের অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। যার দরকার ছিল সে হয়তো পাচ্ছে না। যার দরকার নেই তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এভাবে অক্সিজেনন নষ্ট হচ্ছে। ফলে নিউমোনিয়া আক্রান্ত মৃত্যু কমানের কোন প্রভাব পড়ছে না।
শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, নিউমোনিয়ায় দেশে গত নব্বইয়ের দশকে পাঁচ বছরের নিচের শিশু বছরে মৃত্যুর হার ছিল ১ লাখ। আর ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মৃত্যুর হার কমে ১২ হাজারে নেমেছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে দেশে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু অনেক কমে এসেছে। আর মৃত্যু কমে যাওয়ার কারণ হলো ভ্যাকসিনেশন। আমার যদি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন শুরু করতে পারি তাহলে মৃত্যু আরও কমবে।
নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে এখনো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। প্রধানত কয়েকটি কারণে দেশে বেশির ভাগ শিশু মারা যায়। প্রথমে নিউমোনিয়া হলে কতটা দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থার উপর অনেক শিশুর মৃত্যু নির্ভর করে। প্রি-ম্যাচিউর বা স্বল্প ওজনের নবজাতকের মৃত্যুও ঝুঁকি বেশি এবং বাচ্চার নিউমোনিয়ার সাথে যদি অক্সিজেনের ঘাটতিজনতি সমস্যা থাকে তাহলে শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
ডা. প্রবীর কুমার বলেন, নিউমোনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। আগেভাগে সতর্ক হয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলে নিউমোনিয়ার মতো জটিল অসুখ থেকে শিশুদের রক্ষা করা যায়। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। নিউমোনিয়ার কারণগুলোর মধ্যে অপুষ্টি ও গৃহস্থালির দূষণ ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিবেশদূষণের বিষয়টি সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে তা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। সেটি ইনডোর কিংবা আউটডোর পলিউশন। জন্মের পর শালদুধ ও পূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ পান নিশ্চিত করা। সব সময় শিশুর সঠিক যত্ন নেওয়া।পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া এবং অসুস্থ হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী।
শহরের চেয়ে গ্রামে বাস করা শিশুদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি বলেও জানান এই চিকিৎসক।