দেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের রোগী, প্রতি লাখে আক্রান্ত ১০৬

পুরুষ রোগীদের মধ্যে ৭৫.৮ শতাংশ ধুমপায়ী

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

সারা বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি হলো ক্যান্সার। আর বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি লাখে ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা  হচ্ছে ১০৬ জন। এছাড়াও প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতি লাখে ৫৩ জন। মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই ক্যান্সারের রোগী। এমনকি দেশে থাকা ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যাই বেশি।

 শনিবার (১ ফেব্রুয়ারী)  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে ‘বাংলাদেশে ক্যান্সারের বোঝা : জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি’ শীর্ষক সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৃহত্তর গবেষণার ফলাফলে এ চিত্র দেখা গেছে।

অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন প্রধান গবেষক ও পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান।

তিনি জানান, বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি (পিবিসিআর) না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তথ্য ব্যবহার করে ক্যান্সারের পরিস্থিতি অনুমান করতে হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ক্যান্সারের সঠিক পরিস্থিতি জানার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে। তাই জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্যান্সারের পরিস্থিতি নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

তিনি আরও জানান, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। এই গবেষণায় প্রতিটি বাড়িতে বিশেষভাবে তৈরি করা ইন্টারনেট ভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন সফটওয়্যার করে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহণ করা হয়েছে। এক বছর পূর্তিতে একই পরিবারের ফলোআপ পরিদর্শন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে।

ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, ২ লাখ মানুষের ওপর এই গবেষণা পরিচালন করা হয়। বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের রোগী পাওয়া গেছে। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ২দশমিক ৪ শতাংশ শিশুরা রয়েছে। ৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৫টি প্রধান ক্যান্সার হল স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার। পুরুষদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হল শ্বাসনালি, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যান্সার। নারীদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হল স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি। পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ ধুমপায়ী এবং ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী। ৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যান্সারের সঙ্গে ই-তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে।

চিকিৎসা প্রসঙ্গে গবেষণায় আরও জানা গেছে, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কম্বাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসাই নেয়নি। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। মৃত রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালি ও পাকস্থলীর ক্যান্সার। প্রতি বছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, লিভার ও শ্বাসনালীর ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বেশি।

গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে বলা হয়,  ২ লাখ ১ হাজার ৬৬৮ জন অংশগ্রহণকারী ৪৬ হাজার ৬৩১টি পরিবারের মধ্যে থেকে এই  গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ৪ পুরুষ এবং ৫১ দশিক ৬ শতাংশ নারী।এর মধ্যে মোট ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৪ জন। আর ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রতি প্রতি এক লাখে  ১০৬ (পুরুষদের মধ্যে প্রতি লাখে ১১৮ এবং নারীদের  প্রতি লাখে ৯৬ জন।

গবেষণায়  দেশে মানুষের মধ্যে  ৩৮টি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে  ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগী, যাদের বয়স ১৮-৭৫ বছর । ১৮ বছরের নিচে ২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫দশমিক ১ শতাংশ ছিলেন।

সর্বোচ্চ ৫টি ক্যান্সারে মধ্যে  স্তন ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বর ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, পেট ৭ দশমিক ০ শতাংশ  এবং জরায়ু ৫ দশমিক ১ শতাংশ

 পুরুষদের মধ্যে গলার ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল ১৩ শতাংশ।

অন্যান্য প্রধান ক্যান্সার ছিল পেট ১০ দশমিক ৪ শতাংশ, ফুসফুস ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বর  ৭ শতাংশ এবং খাদ্যনালী ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

নারীদের মধ্যে, স্তন ক্যান্সার ছিল সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

এছাড়া জরায়ুর ক্যান্সার ১১ দশমিক ১ শতাংশ।  ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বরের ক্যান্সার ১০ দশমিক ১ শতাংশ  , থাইরয়েড ৭ দশমিক ১ শতাংশ  এবং ডিম্বাশয় ৫ দশমিক ১ শতাংশ । অন্যান্য প্রধান ক্যান্সারের মধ্যে ১৯ শতাংশ মহিলা ক্যান্সার রোগী নারী প্রজনন সিস্টেমের ক্যান্সারে আক্রান্ত (জরায়ু ১১ শতাংশ, ডিম্বাশয় ৫ শতাংশ।ক্যান্সার রোগীদের সহ-রোগের মধ্যে ছিল উচ্চ রক্তচাপ (১৭ শতাংশ), ডায়াবেটিস (১১ শতাংশ), হৃদরোগ (৬ শতাংশ), দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (৩ শতাংশ) এবং স্ট্রোক (২ শতাংশ)। ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ ক্যান্সার রোগী ছিলেন ধূমপায়ী। ৪০দশমিক ৫ শতাংম পুরুষ এবং ৬০ দশমিক ৬ শতাংম নারী তামাকবিহীন সেবন করতেন। সর্বমোট ক্যান্সারের ৪৬ শতাংম তামাক (ধূমপান ও তামাকবিহীন) সেবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ৬০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী সার্জারি, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সংমিশ্রণ চিকিৎসা পেয়েছিলেন। ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীকে কোনো চিকিৎসা প্রদান করা হয়নি।

গত বছরের ১ জুলাই এবছরের  ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত   ১৩ হাজার ৪১১টি পরিবারের ৫৮ হাজার ৫৩৯ জন অংশগ্রহণকারীর ফলোআপ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক বছরে নতুন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা যুক্ত হয়েছে প্রতি লাখে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, নিত্যনতুন জ্ঞান তৈরিতে গবেষণার বিকল্প নাই। বিএসএমএমইউ থেকে সেই গবেষণায় পরিচালনা করা উচিত যা রোগীদের কল্যাণে কাজে আসে। যেসকল গবেষণা দেশের মানুষের, দেশের রোগীদের উপকার হবে সেক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

সভাপতির বক্তব্যে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, গণআকাঙ্খা পূরণ করে এমন গবেষণার জন্য ফান্ডের কোনো সমস্যা হবে না। বিএসএমএমইউর উদ্যোগে পরিচালিত বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থেকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তা দেশের মানুষের ক্যান্সার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় বিরাট ভূমিকা রাখবে। একই সাথে এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার বহুমুখী দ্বার উন্মোচন করেছে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর  অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হক প্রমুখ।

 

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com