৯১
স্টাফ রিপোর্টার ।।
দেশে প্রথম দুরারোগ্য ব্যাধি এইচআইভি ভাইরাস (এইডস) রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। বর্তমানে অনুমিত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩ জন। তবে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এইডস শনাক্ত হওয়া চিহ্নিত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৭০৮ জন। এ সময়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৮২০ জন। বর্তমানে জনসাধারণের মধ্যে রোগটি প্রাদুর্ভাবের হার শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশেরও কম। আর এইডসে আক্রান্ত হয়েও সঠিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ সন্তান জন্ম দিচ্ছে রোগীরা। দেশে ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এইডস আক্রান্ত নারী ২৭০ জন সন্তান প্রসব করেছে। যার মধ্যে ২৫৯ জন নবজাতক এইচআইভি মুক্ত ছিল।
জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য মতে, চলতি বছরে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে বিদেশ ফেরত ১০২ জন বা ৬৬ শতাংশ রোগী। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম। তবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখে বলে আক্রান্ত ব্যক্তি রোগের কথা গোপন রাখেন। ফলে সহজে রোগ ছড়ায়। এ ছাড়া দেশে এখন পর্যন্ত এসব রোগীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো হাসপাতাল তৈরি হয়নি। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুব্যবস্থাও রাখা হয়নি। এতে রোগীরা গোপন করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে সাধারণ অসুখেও মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা আগামী ২০২৫ সাল। এ সময়ের মধ্যে রোগটির প্রতিরোধ সম্পর্কে ৯৫ ভাগ মানুষকে সচেতন করতে হবে। শনাক্ত হওয়া ৯৫ শতাংশ রোগীকে এআরটি সেন্টারের মাধ্যমে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। ৯৫ ভাগ এআরটি সেবাগ্রহীতা রোগীর দেহে ভাইরাল লোড ৫০ কপি প্রতি মিলিলিটারে নিচে আনতে হবে। এই তিনটি ৯৫ অর্জন সম্ভব হলে রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতার লক্ষ্যে আজ ‘বিশ্ব এইডস দিবস’ পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারে প্রতিপাদ্য ‘কমিউনিটির আমন্ত্রণ, এইডস হবে নিয়ন্ত্রণ’। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে দিবসটি পালিত হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সবশেষ ২০২২ সালের তথ্য মতে, দেশে অনুমিত এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ এখনও শনাক্তের বাইরে। যারা শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আছেন।
অধিদফতরের একটি বিশ^স্ত সূত্র জানিয়েছে, এ বছর নতুন এইচআইভি শনাক্ত রোগী ১ হাজার ছাড়িয়েছে। এর আগে কোনো বছর এত রোগী শনাক্ত হয়নি। চলতি বছরে মৃত্যু হয়েছে ১২০-১৩০ জনের। এর আগের বছর ২০২২ সালে দেশে এইডসে মৃত্যু হয়েছিল ২৩২ জনের।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, এইডস রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ মতো অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টার থেকে নিয়মিত প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনে সুস্থ সন্তান প্রসব করছে। সঠিক নিয়মে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ সন্তান প্রসবে সফলতার হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। আর এইডস চিকিৎসায় সারা দেশে ২৩টি এআরটি সেন্টারে আসা রোগীরা এই সফলতা পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ এআরটি সেন্টারে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া দেশে প্রতি বছর যে সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত হচ্ছে তার ৫০ শতাংশই প্রবাসী। এর মধ্যে গর্ভবতী নারী রয়েছেন শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বলা হচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ এইডস পজেটিভ মা তিনভাবে সন্তানের দেহে ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে গর্ভকালীন সময় থেকে প্রসবপূর্বকালীন সময় পর্যন্ত ১-১২ শতাংশ পর্যন্ত ছড়াতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় ছড়াতে পারে ৮ শতাংশ। শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে ৭ শতাংশ আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে ৬-২৪ মাস পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে ৩ শতাংশ শিশু।
এইডস পজেটিভ গর্ভবতীদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০১৩ সাল থেকে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ‘প্রেগনেন্ট মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন প্রোগ্রাম (পিএমটিসিটি)’ কার্যক্রম চালু করে। বর্তমানে ইউনিসেফের কর্মসূচি বন্ধ থাকলেও সরকারিভাবে পরিচালিত কেন্দ্রে আসা রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শে এই সেবা নিতে পারছেন। এসব কেন্দ্রের মধ্যে বিএসএমএমইউ, পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যশোর জেলা সদর হাসপাতাল এবং কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালসহ উখিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে এই কার্যক্রম আছে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির সিনিয়র ম্যানেজার মো. আখতারুজ্জামানের মতে ৫টি হাসপাতাল বা ১৩টি এআরটি সেন্টারের মাধ্যমে মা থেকে শিশুর এইডস সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এ জন্য প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে এবং বেসরকারি হাসপাতালে এই সেবা চালু করতে হবে। এসব কেন্দ্রে মা থেকে সন্তানকে এইডস মুক্ত রাখতে গর্ভধারণের পূর্বে এইচআইভি পরীক্ষা করতে হবে। আক্রান্ত গর্ভবতী নারীকে গর্ভধারণের আগে থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবন করতে হবে। সুস্থ সন্তান জম্মদানে নিরাপদ ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে জোর দিতে হবে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের ম্যানেজার (ডাটা ও আইটি) মো. আলাউদ্দীন চৌধুরী বলেন, দেশে সরকারিভাবে পরিচালিত ১৩টি এআরটি সেন্টার রয়েছে। এইচআইভি পরীক্ষাকেন্দ্র আছে ১০টি। এ ছাড়া ৯টি কারাগারে এইডস শনাক্ত ও পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলোÑঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ), গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার-১ ও ২, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী, কুমিল্লা ও যশোর জেলখানায় এই সুবিধা রয়েছে।
তিনি বলেন, পাশাপাশি বেসরকারিভাবে পরিচালিত ১১৫টি ড্রপ ইন সেন্টার রয়েছে। যেখানে সন্দেহভাজনদের বিনামূল্যে এইডস শনাক্তকরণ, চিকিৎসা প্রদান, ওষুধ ও ভাইরাস প্রতিরোধী উপকরণ সরবরাহ করা হয়। গত বছরের শেষের দিকে আরও ৯টি জেলায় এইচআইভি প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে নিয়মিত কাউন্সেলিং, পরীক্ষা, চিকিৎসা, ওষুধ ও উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে।
রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ডা. আরিফুল বাশার বলেন, এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সাধারণত প্রথমে কোনো লক্ষণ থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং বিভিন্ন অসুখে ভোগা শুরু হয় তখন পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত হয়। এইচআইভি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। হাঁচি, কাশি বা থুতুর মাধ্যমে, একই পাত্রে খাবার বা পানি খেলে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সামগ্রী ব্যবহার করলে, তার ব্যবহৃত টয়লেট ব্যবহার করলে আপনিও এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না। একসঙ্গে ওঠা-বসা খেলাধুলা বা স্পর্শ করলে, হাত মেলালে, জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে রোগটি ছড়ায় না। এ কথাগুলো এখন মানুষের মধ্যে পৌঁছায়নি। তিনি বলেন, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুচ-সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে কনডম ব্যতীত যৌন মিলন করলে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায়। এ ছাড়া মা থেকে গর্ভাবস্থায় প্রসবের সময় অথবা বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমেও সন্তান আক্রান্ত হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, এইডস আক্রান্ত কোনো পুরুষ বা নারী চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সঠিক নিয়মে ওষুধ খেলে একসময় তার রক্তে এইচআইভি ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকে না। এতে আক্রান্ত স্বামীর শুক্রাণুর মাধ্যমে যে পরিমাণ ভাইরাস স্ত্রীর দেহে প্রবেশ করলে স্ত্রীও পজেটিভ হবে, স্বামী নিয়মিত এইডসের বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ সেবনের ফলে রক্তে এবং শুক্রাণুতে সেই পরিমাণ ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকে না। একইভাবে এইডস আক্রান্ত নারীর থেকে গর্ভের সন্তানের শরীরে যতটুকু পরিমাণ ভাইরাস যাওয়ার দরকার, ওই নারী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ নিয়মিত সেবনের ফলে রক্তে ভাইরাসটির অস্তিত্ব থাকে না। তখন তার গর্ভস্থ শিশু এইডস ছাড়াই জন্ম নিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পজেটিভ ব্যক্তির রক্তে এইচআইভির ভাইরাল লোড তথা ভাইরাসের মাত্রা অবশ্যই প্রতি মিলিলিটারে ৫০ কপির (সংখ্যা) নিচে থাকতে হবে। এইচআইভি রোগীর শরীরে ভাইরাল লোড ১ হাজারের ওপরে থাকলে পরিস্থিতি খারাপ ধরা হয়।