দেশের ৩৬ শতাংশ শিশু ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমায় আক্রান্ত

আইসিডিডিআরবির গবেষণা

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের (নন কমিউনিকেবল ডিজিজ) ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় শিশুদের জন্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ সেবাদান মডেলের পরীক্ষামূলক গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমায় সর্বোচ্চ সংখ্যক (৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ) শিশু অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়।

আইসিডিডিআরবি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সঙ্গে যৌথভাবে এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর সহযোগিতায় গবেষণাটি হয়। জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় শিশুদের অসংক্রামক রোগের জন্য সেবা অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে এটি একটি বেশ বড় পদক্ষেপ।

মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীতে আইসিডিডিআর,বি-র সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘ডিজাইনিং অ্যান্ড পাইলটিং পেডিয়াট্রিক এনসিডি সার্ভিস মডেল ফর চিলড্রেন অ্যান্ড এডোলেসেন্টস অ্যাট প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিস ইন বাংলাদেশ,’ শীর্ষক সেমিনারে এ গবেষণা প্রকল্পের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে শিশুদের প্রধান দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগগুলো চিহ্নিত করা এবং এই রোগগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে একটি সমন্বিত সেবাদান মডেল তৈরি করাই ছিল গবেষণাটির লক্ষ্যে।

২০১৯ সালের গ্লোবাল বার্ডেন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ২১০ কোটিরও বেশি শিশু অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় এবং এই ধরনের রোগের কারণে প্রায় ১০ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। তবে বাংলাদেশে শিশুদের অসংক্রামক রোগ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য উপাত্ত নেই, যা গবেষণা, চিকিৎসা ও নীতিনির্ধারণে ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পেন-প্লাস কার্যক্রমের আওতায় অগ্রাধিকারভুক্ত শিশুদের অসংক্রামক রোগ যেমন-রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ এবং সিকল সেল ডিজিজ মূলত সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশি দেখা গেলেও এসব রোগ বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তেমন একটা দেখা যায় না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সংক্রামক রোগের প্রকৃত ঝুঁকিকে গুরুত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে এই গবেষণার আওতায় শিশুদের ছয়টি প্রধান অসংক্রামক রোগ নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো ব্রংকিয়াল অ্যাজমা, জন্মগত হৃদ্রোগ, মৃগী রোগ (এপিলেপসি), থ্যালাসেমিয়া, কিডনি রোগ এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস। একটি সমন্বিত ও প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে এ রোগগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের সংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় চিকিৎসাসেবা প্রোটোকল তৈরি করা হয়। যা শিশুদের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা নির্দেশনা দেয়। এর ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের ১২টি ও বাগেরহাটের ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং দুইটি জেলা হাসপাতালে একটি পূর্ণাঙ্গ সেবা প্রদান মডেল কার্যকর করা হয়। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের জন্য নিবেদিত এই সেবা উল্লিখিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে একীভূত করা সম্ভব হয়েছে।

 

এই গবেষণার আওতায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় শিশুদের সংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান মূল ঘাটতিগুলো মূল্যায়ন করা হয়। চিকিৎসক, নার্স, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার এবং মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়। পাশাপাশি সামাজিক আচরণগত পরিবর্তন বিষয়ক যোগাযোগ উপকরণ প্রস্তুত করা হয়। রোগীর তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি নিবন্ধন পদ্ধতি এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাসিক প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য একটি ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়।

এই গবেষণার আওতায় প্রথম সাত সপ্তাহে ৩৮৫ জন শিশুর অসংক্রামক রোগ নির্ণয় ও নিবন্ধন করা হয়েছে। নিবন্ধিত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমায় ৩৬ দশমিক ৬শতাংশ), এরপর থ্যালাসেমিয়া ও আয়রন ডেফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়াতে ২৭ দশমিক ৫শতাংশ), জন্মগত হৃদ্রোগ (১৯ দশমিক ১ শতাংশ), মৃগী রোগ ১৩ দশমিক ৬শতাংশ, নেফ্রোটিক সিনড্রোম (২ দশমিক ২ শতাংশ এবং টাইপ ১ ডায়াবেটিসে ১ শতাংশ। প্রায় ৮ শতাংশ রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে রেফার করা হয়েছে।

সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করতে ২০০-এর বেশি চিকিৎসক, নার্স ও সাব-অ্যাসিসট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার এবং ৫০০-এর বেশি কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই গবেষণাকে সফল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেসড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখাও সহযোগিতা করেছে।

পরিচালনাগত কিছু চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছে এই মডেল গ্রহণযোগ্য ও প্রযোজ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরীক্ষামূলক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য জাতীয় রোডম্যাপ তৈরি করতে সহায়ক হবে, যা পাইলট জেলাগুলোতে সেবা শক্তিশালীকরণ এবং সারাদেশে সম্প্রসারণের দিকনির্দেশনাহিসেবে কাজ করবে।

এই কার্যক্রম বাংলাদেশ সরকারের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ) এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরাসরি অবদান রাখবে, বিশেষত শিশু স্বাস্থ্য ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখার প্রাক্তন পরিচালক ও হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম ও ই-হেলথ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক শাহ আলী আকবর আশরাফী, এবং এনসিডিসি প্রোগ্রাম লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক সৈয়দ জাকির হোসেন।

অধ্যাপক সৈয়দ জাকির হোসেন তার বক্তব্যে অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধের ওপর জোর দেন এবং এই গবেষণার ফলাফল থেকে প্রাপ্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত করার আহ্বান জানান।

অধ্যাপক শাহ আলী আকবর আশরাফী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত লিফলেটগুলো কমিউনিটিতে মায়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ওপর জোর দেন।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের ম্যাটারনাল নিউবর্ন চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথের হেলথ ম্যানেজার দেওয়ান মো. এমদাদুল হক শিশুদের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা সেবার আরও উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিষয়ে আশাবাদ জানান।

গবেষণার প্রধান গবেষক, আইসিডিডিআরবির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. আলিয়া নাহিদ বলেন, এই গবেষণা বাংলাদেশে শিশুদের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসায় একটি টেকসই ও সম্প্রসারণযোগ্য মডেল স্থাপনের ভিত্তি রচনা করেছে, যা শুধুমাত্র শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করছে না বরং তাদের ভবিষ্যতেও সুস্থ ও সক্ষম জীবনযাপনের সম্ভাবনা নিশ্চিত করছে।

আইসিডিডিআর,বি-র নিউট্রিশন রিসার্চ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর থেডিয়াস ডেভিড মে সমাপনী বক্তব্যে এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সফলভাবে সম্পন্ন করতে অবদান রাখার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

 

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com