নিজস্ব প্রতিবেদক।।
গণ অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মর্গের হিমঘরে ছয় জন নয়, সাত জনের মরদেহগুলো এখনও পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে ছয় পুরুষ আর একজন মহিলা। শনিবার কাবিল হোসেন নামে একজনের পরিচয় শনাক্ত করেছেন তার স্ত্রী সেলিনা বেগম। তিনি ঢামেকের মর্গ থেকে তার লাশ শনাক্ত করেন। ছয় মাস ধরে লাশগুলো পড়ে থাকলেও পরিচয় শনাক্তের অভাবে লাশগুলো হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। শুধু মৃতদেহগুলোর ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। আর দীর্ঘদিন হিমঘরে থাকার কারণে লাশগুলো বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ কিংবা কোন ছবি তোলা হয়েছিল কি-না সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। জুলাই ছাত্র জনতার অভ্যূত্থানে স্বজন হারানো কেউ না কেউ এসে লাশগুলো দেখছেন। কিন্তু বিকৃত হয়ে যাওয়ায় কেউ এখন পর্যন্ত তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। একজন বয়বৃদ্ধ মরচ্যুয়ারির সামনে বসে থাকেন। কান্নাকাটি করেন। তার ছেলের লাশ এখনও খুঁজে পাচ্ছেন না মর্গের লোকদের জানিয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষা না করে লাশগুলো হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও চিকিৎসকরা।
তবে চিকিৎসারা জানান, লাশগুলো ফিঙ্গার প্রিন্ট কিংবা ছবি থাকলে লাশগুলো সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হতো। লাশগুলো দীর্ঘদিন হিমঘরে থাকার কারণে বিকৃত হয়ে গেছেন এবং আঙ্গুলের ছাপ মূছে গেছে। তাই ডিএনএ পরীক্ষা করা ছাড়া কোনভাবেই লাশগুলো শনাক্ত করা নয়।
ঢামেক মর্গ সূত্র জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকেই হাসপাতালে লাশগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। আর এ লাশ গুলো এসেছে ৬ থেকে আগস্ট থেকে ২২ আগস্টের মধ্যে। লাশগুলোর ময়নাতদন্তে পাঁচজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে ‘আঘাতজনিত মৃত্যু’।
মরদেহের ময়নাতদন্তে একজনের মৃত্যু লেখা রয়েছে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে এবং খাতায় লেখা এনামুল নামের মৃত্যুর কারণ ‘ওপর থেকে নিচে পড়ে মৃত্যু’। তবে এই এনামুল নিহতের নাম কিংবা যে হাসাপাতালে যে নিয়ে এসেছেন তার নাম সে ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। আর কোনো তথ্য পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ।কয়েকজনের লাশের বিষয়ে হাসপাতালে এন্ট্রি খাতায় বাহকের নাম হিসেবে দেওয়া হয়েছে পুলিশের মোবাইল নাম্বার। আর সেই সব মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে পুলিশ ফোন ধরছেন কিন্তু তারা কোন তথ্য দিতে পারেনি।
হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানান, মহদেহ গুলো বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। লাশগুলোর ডিএনএ সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়েছিল কি-না সেই তথ্য তাদের জানা নেই। সেটি পুলিশ ভাল বলতে পারবে। কারণ এই লাশগুলোর দ্বায়-দ্বায়িত্ব এখন পুলিশের কাছে। তবে ফিঙ্গার প্রিন্ট কিংবা ছবি থাকলে লাশগুলো সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হতো । এখন যেহেতু অনেক হয়ে গেছে সেই জন্য আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া নয়। আর পুলিশও বলছে, লাশগুলোর খোঁজে অনেকেই আসছেন। তাদের ডিএনএ নেওয়া হচ্ছে। আর কেউ শনাক্ত করেন কি না, তা দেখার জন্য বেওয়ারিশ লাশগুলো আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে দেওয়া হয়নি।
গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণঅভ্যুত্থান-বিষয়ক বিশেষ সেলের সদস্যরা ৬ বেওয়ারিশ লাশের তথ্য জানিয়েছিল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞাতনামা লাশগুলো হলো পুরুষ (২০), অজ্ঞাতনামা পুরুষ (২৫), অজ্ঞাতনামা পুরুষ (২২), অজ্ঞাতনামা নারী (৩২) ও অজ্ঞাতনামা পুরুষ (৩০) এনামুল (২৫),
খাতায় আরেক জনের ব্যাপারে লেখা আছে কণ্যাণ থেকে এসেছেন বয়স ৩৫। তবে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। সাত মরদেহের মধ্যে মর্গে লাশগুলো এসেছে আগস্টের ১৬ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে। এর মধ্যে ১৭ তারিখে দুইজনের, ১৯ তারিখে তিনজনের এবং ২২ তারিখে দুইজনের।
ঢামেক মর্গের ডোম (ইনচার্জ) রামু দাস সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের এখানে সাত জনের মরদেহ আছেন। এর মধ্যে ৬ জনের লাশ এসেছে শাহবাগ থানা থেকে এবং একজনের মহরদেহ যাত্রাবাড়ির থানা থেকে আসছে।
তিনি বলেন, লাশগুলো শনাক্ত করতে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন স্বজনরা আসছেন। প্রথমদিকে অনেকেই আসতো কিন্তু মাঝে মধ্যে একজন/দ্জুন আসেন। এর মধ্যে একজন বয়স্ক মানুষ প্রায় সময়ই আসেন। কিন্তু লাশগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে কেউ চিনতে পারছেনা এবং শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। একজনের নাম এনামুল পাওয়া গেলে কোন স্বজন পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সময়ে কিছু বেওয়ারিশ লাশ পুলিশের মাধ্যমে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে দেওয়া হয়েছে। আর এখানো যারা লাশের খুঁজে আসেন তাদেরকে ডিএনএ টেস্টের জন্য শাহবাগ থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।
ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমান বলেন, জুলাই-আগস্টের মধ্যে যে মরদেহ গুলো আমাদের এখানে আসছে তাদের অনেকের আমরা ময়নাতদন্ত করেছি। তার এখনো সাতজনের মরদেহ হিমাগারে রয়েছেন। আর এই লাশগুলো যেহেতু অজ্ঞাতনাম এবং কোন ভাবেই শনাক্ত সম্ভব হয়নি। তাই আমরা পুলিশের কাছে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দেই এবং লাশগুলো বুঝিয়ে দিয়েছি। আর যেহেতু লাশগুলো শনাক্ত হয়নি তাই পুলিশ আমাদেরকে অনুরোধ করেছিল লাশগুলো হিমাগারে রেখে দিতে। সেইজন্যই রাখা হয়েছে। আর পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬ জনের পুরুষের মধ্যে এক জনের দেহে শর্ট গানের গুলি ছিল। আর মহিলাসহ বাকীদের নানা ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।আর আমরা যেহেতু ময়নাতদন্তের পরপরই পুলিশকে বুঝিয়ে দিয়েছি তাই এখন পুলিশের দ্বায়িত্ব তারা কি কিভাবে শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংরক্ষিত রয়েছে। তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়েছিল কিন্তু কারও সাথে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং হয়নি। ফিঙ্গার ম্যাচ করলে তো এতদিন শনাক্ত হয়ে যেত।
তিনি বলেন, লাশের গুলি প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে দেখে যান, কিন্তু কেউ এখন পর্যন্ত লাশগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। কেউ শনাক্ত করেন কি না, সেই জন্যই ঢামেকে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে। যারা আসছেন তাদের ডিএনএ সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে। আমাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানেন। আমাদের বেতার বার্তা ও বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়ায় ছবি দেওয়া আছে। আরও দুটি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। সুতরাং লাশগুলো নিয়ে আমাদের কাজ চলছে।
শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলন ৬ জনের বেওয়ারিশ লাশের তথ্য প্রথম সামনে আনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেল।
বিশেষ সেলের সেক্রেটারি হাসান ইনাম বলেন, রুটিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, ঢামেক হাসপাতালে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ছয়জনের বেওয়ারিশ লাশ রয়েছে। শুক্রবার সকালে সেলের একটি টিম এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য শাহবাগ থানায় যায় এবং শাহবাগ থানার ওসি ছয়টি লাশ এখনো হিমাগারে থাকার তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন,শাহবাগ পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে এই লাশগুলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের। তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ। তবে লাশগুলো কবে এখানে আনা হয়েছে, পুলিশ তা স্পষ্ট করেনি।
কারও পরিবারের সদস্য নিখোঁজ থাকলে ০১৬২১৩২৪১৮৭ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন জুলাই গণ-অভুত্থ্যান বিষয়ক বিশেষ সেলের নেতারা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, জুলাই- আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ২৫২ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬২ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। বাকি ৮৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আহত মোট হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ হাজার ৭০০জন রোগী। আর বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ১৩ জন জন। তাদের সবার অবস্থা গুরুতর। কার মাথা কিংবা পেটে-পিঠে বা অন্য কোথাও গুলি লেগেছে। আবার কারো অর্থপেডিক্স বা হাড় জোড়া লাগানো সমস্যা এবং প্লাস্টিক সার্জারি রোগী রয়েছেন। আর ১৩ জনের মধ্যে থেকে ৬ জন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ জনকে থাইল্যান্ড পাঠানো হচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানান, তিনজন রোগীর বিদেশে যাওয়ার কাগজপত্র প্রস্তুুত রয়েছে। সরকারের যে কোন বিদেশে পাঠাবেন। আর তিন জনের কাগজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে।
হাসপাতালে সাত জনের মরদেহের শনাক্ত ও লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে ঢামেকে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এখনো সাতজনের মরদেহ আছে। বিষয়টি মরদেহ গুলো মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে অধীনে থাকে। মারা যাওয়ার পর ফরেনসিক বিভাগ ময়নাতদন্ত করে পুলিশের কাছে সব প্রতিবেদন পাঠায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তবে মরদেহের ফিঙ্গার রাখা হলে পরিচয়পত্র দিয়ে লাশগুলো শনাক্ত করা সম্ভব। এখন দেরি হওয়ার কারণে ডিএনএ ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
বিদেশে ৬ জনের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, আহতদের সবাই খুবই ক্রিটিক্যাল। তাদের কারও নার্ভ ইনজুরি, আবার কারও গুলি লেগে ছিদ্র হয়ে গেছে এবং এখনো অনেক গুলি ভেতরে রয়েছে। আবার কারও জেনারেল সার্জারি ও প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে। তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কমিটির মাধ্যমে বিদেশে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনজন দ্ইু/একদিনের মধ্যে বিদেশ যাবেন। আর বাকী জনের কাগজপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আন্দোলেনের সময়ে ঢামেকে চিকিৎসকের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি স্মরণ করে পরিচালক বলেন, আন্দোলনের সময় অনেককে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকেই মারা গেছেন। কারও মাথায়, কারও বুকে, কারও হাতে-পায়ে গুলির চিহ্ন। মর্গে সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য লাশ রাখাছিল। হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতে খেতে হয়েছে চিকিৎসকদের। তখন সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নার্সের ছুটি বাতিল করে দিয়ে তাঁদের সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছিল। ডাক্তাররা দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আবার আহত নিহতদের স্বজনদের কান্না-আহাজারি তো ছিলই। আবার অনেকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই অনেকেই লাশ জোড় নিয়ে গেছেন। তখন পুলিশও সক্রিয় ছিল না। আবার রোগীর স্বজনও চাননি ময়না তদন্ত হোক। আবার সেই পরিবেশও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ফলে তাদের অনেকের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। মোট কথা সবকিছু ম্যানেজ করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন পরিস্থিতি ছিল।