নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলো দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। কিন্তু দেখে তো মনে হয় না। দেখে মনে হচ্ছে হাসপাতাল তো নয় যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের মধ্যে বসবাস করছি। চারপাশের পরিবেশ এতটাই নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন যে টিকে থাকায় দায়। আর আবর্জনার দুর্গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। আর টয়লেটের কথা কি বলবো গেলেই বমি চলে আসে। নাক- মুখ চেপে ধরেও যাওয়া না। এই অবস্থায় একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই কথা বলছিলেন হালিমা আক্তার। তিনি তার মাকে নিয়ে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার নিউরো সার্জারির (মহিলা পেইং) ২০০ নং ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। একই অভিযোগ তার আশপাশে থাকা এবং পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তিসহ অসংখ্য রোগী স্বজনদের।
সরেজমিনে হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিউরো সার্জারির পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, শত রোগী ও স্বজনদের উপচে পড়া ভিড়। নির্ধারিত শয্যার বাইরেও সামনের মেঝে, করিডোর এবং ঢাল সিঁড়িতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যত্রতত্র পড়ে আছে পচা রক্তের ব্যাগ, রক্তমাখা ব্যান্ডেজ, নোংরা ও আবর্জনা কাগজ, বোতল এবং ড্রেসিং ও অপারেশনে ব্যবহৃত গজ তুলাসহ অন্যান্য বর্জ্য। এখানকার টয়লেটের অবস্থা আরও ভয়াবহ। নিধারিত ডাস্টবিনে উপচে পড়ে আছে পচাবাসী খাবারের প্যাকেট, পলিথিন, তুলা, টিস্যুসহ সব প্রকারের উচ্ছিষ্ট এবং মেডিকেল বর্জ্য। টয়লেটের পানি এসে গড়িয়ে পড়ছে বাইরে বারান্দা থেকে মেঝেতে শুয়ে থাকা রোগীর ওপর। শুধু এই দৃশ্য সার্জারি বিভাগে নয় পুরাতন ভবনের প্রতিটি ওয়ার্ড এবং টয়লেট জুড়েই একই অবস্থা দেখা গেছে। এমন অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে চিকিৎসা নিতে রোগী ও স্বজন, চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের।
তাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রোগী ও দর্শনার্থীরা দুর্গন্ধে নাকাল হয়ে উঠলেও নীরব ভূমিকায় রয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে সর্বত্রই যত্রতত্র পড়ে আছে বর্জ্য। কর্তপক্ষের উদাসিনতায় এবং অব্যবস্থাপনার কারণে হাসপাতালের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে।
সরেজমিনে ঢামেক পুরাতন ভবনে বিভিন্ন ওয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ময়লা-আবর্জনা, টিস্যু ফেলার জন্য নেই কোনও ঝুড়ি। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা আর মেডিকেলবর্জ্যের স্তূপ। প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে হাজারো রোগীর চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত বর্জ্য যেমন- সিরিঞ্জ, সূচ, রক্ত, পুঁজযুক্ত তুলা, ব্যান্ডেজ-গজ, হ্যান্ডগ্লাভস, ওষুধ ও ওষুধের বোতল-শিশি, ব্লাড ব্যাগ, স্যালাইন ব্যাগসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। টয়লেটে মধ্যে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা থাকলেও তা কমই কম। ডাস্টবিনের ময়লা উপচে পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে চারপাশে। পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেই। টয়লেটগুলোর ভেতরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। টয়লেটের সামনে রোগী ও তাদের স্বজনদের দীর্ঘ সিরিয়াল। নেই কোন ছিটকানি ও বদনা এবং পানির ব্যবস্থা। আবার কোনটায় দেখা গেছে মানুষের মল ত্যাগে ভরে গেছে। টয়লেটে পানি বাইরে এসে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আর পপানি জমে আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। উচ্ছিষ্ট খাবারসহ নানা ময়লা-আবর্জনার ফেলার কারণে মশা-মাছি ভনভন করছে। পানি জমে স্যাঁত স্যাঁত হয়ে আছে। কাগজ, পলিথিন ব্যাগ, কাগজ, চিপসের প্যাকেট, খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, ইঞ্জেকশনের এ্যাম্পুল, অপারেশনে ব্যবহৃত গজ তুলাসহ মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন পত্র পড়ে রয়েছে। এছাড়াও মেডিকেলে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল জাতীয় দ্রব্য, পুরাতন আববাব পত্র, চেয়ার-টেবিল ও ট্রলিসহ চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত জীবাণুযুক্ত তুলো এবং বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যদিও হাসপাতালের নতুন ভবনের ওয়ার্ডসহ টয়লেটেগুলোর পরিবেশ কিছুটা উন্নত দেখা গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছে, হাসপাতালে ভেতরের সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা আবর্জনা আর নোংরা পরিবেশে হাসপাতাল যেন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও দুর্গন্ধের কারণে কঠিন। সুস্থ হতে এসে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
হাসপাতালে দ্বিতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডের ২০৭ ওয়ার্ডেও বারান্দায় গিয়ে দেখা গেছে, পুরাতন আববাবপত্রসহ পুরো বারান্দায় যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তুপ হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রতিনিয়ত এখানে ফেলা হচ্ছে খাবারের উচ্ছিষ্ট ও হাসপাতালের বর্জ্যসহ নানা আবর্জনা। ময়লা ফেলার নিদিষ্ট কোন ঝুঁড়ি নেই। দীর্ঘদিন ফেলে রাখা আবর্জনার স্তুপ থেকে তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা ট্রলিসহ পুরাতন নানা আববাবপত্রে ওপর পড়ে আছে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত স্যালাইন, টিস্যু, জীবাণুযুক্ত তুলো, ব্যান্ডেজ এবং অনেক পরিত্যক্ত জিনিসপত্র। দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার না করায় রীতিমতো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এখানে থাকা নোংরা বেসিনের পানি থেকে থালা বাসন থেকে শুরু করে হাত-ধোয়াসহ নানা কাজে এই পানি রোগীদের ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
এই ওয়ার্ডে চার বছরের শিশুকে নিয়ে ভর্তি নূর জাহান বেগম। তিনি আবর্জনাগুলো পচে বিকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ওয়ার্ড পর্যন্ত চলে আসে। এসব দুর্গন্ধ সহ্য করা যায় না। এমনকি ভাত খেতে গেলেও বমি আসে। কিন্তু কি করবো আমরা নিরুপায়। বাচ্চাকে চিকিৎসা দিতে এসে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক আইসিসিইউ নিওনেটাল সার্জারি ও শিশু সার্জারি বিভাগে টয়লেট ও গোসল খানার সামনে গিয়ে দেখা গেছে, শারীরিক প্রতিবন্ধী, শিশু -নারী ও পুরুষরা ও রোগীর স্বজনরা উৎকট দুগন্ধ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। টয়লেটগুলোর ভেতরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। কয়েকটি টয়লেট দরজা নেই। কেউ টয়টেলের ভেতরে প্রবেশ করলে বাইরে থেকে একজনকে পাহাড়া দিতে হয়। এতে করে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের। আবার কিছু টয়লেট ব্যবহার করার কারণে মলমূত্রে ভরে গেছে। ময়লা-আবর্জনা, টিস্যু ফেলার জন্য নেই কোনও ঝুড়ি।
ওয়াসরুমে যাওয়ার সামনে পড়ে আছে তিনটি ময়লার বক্স। যা আগত রোগীর স্বজনদের পাশাপাশি হাসপাতালে কর্মরত স্টাফ ও আশপাশের দোকানদারেরা সারাদিনই পরিত্যক্ত জিনিসপত্র ফেলে যাচ্ছেন। আর একজনের দেখাদেখি অন্যরাও এখানে ময়লা ফেলছেন।নানা ধরনের মেডিকেল বর্জ ও খাবারের উছিষ্ট ফেলার কারণে চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। টয়টেলের ব্যবহৃত পানি চারপাশে গড়িয়ে পড়ছে। আর চিকিৎসা নিতে এসে ওয়াসরুমে প্রবেশপথেই নাকে টিপে ধরতে হচ্ছে মানুষজনকে।
হাসপাতালে সেবা নিতে হ্যাপি আকতার নামে এক রোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টয়লেটে দরজার ছিটকানি নেই। দড়জা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখি আরেকজন ভেতরে। একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি। আর টয়লেটগুলো যেন মলমূত্র ও ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। মনে হয় না দিনে একবারও পরিষ্কার করে।
নাক মুখ চেপে এখানে ময়লা ফেলতে এসেছেন কোহিনূর নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, আমি এক সপ্তাহ ধরে মেয়েকে নিয়ে এখানে ভর্তি। আমি প্রতিদিনই দেখি সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত নানা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ময়লা ভরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এখানে বক্স না রাখলে কেউ তো ময়লা ফেলতো না। আর ময়লা ফেললেও ঠিক সময়ে কেউ পরিস্কার করছে না। ফলে এখান থেকে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হাসপাতালের তৃতীয় তলায় এ্যানেস্থসিয়া বিভাগে অফিসকক্ষের পাশেই বর্জ্যের বিকট দুর্গন্ধ। হাসপাতালে ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন টয়লেটে খাবারের উচ্ছিষ্ট,পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল, ওষুধের বোতল, ইনজেকশনের শিশি-সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ-গজ, স্যালাইনের প্যাকেট, রক্ত ও পুঁজমাখা তুলা-গজসহ নানা মেডিকেল বর্জ্য চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এছাড়াও ধারণক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশি রোগী। শয্যা সঙ্কুলান না হওয়ায় ঠাঁই নিতে হচ্ছে মেঝেতে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে। টয়লেটের দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে মশা, মাছি ভোঁ ভোঁ করছে।
হাসান নামের এক রোগী বলেন, দুর্গন্ধের কারণে সব সময় মাস্ক পরে থাকতে হয়। অনেক সময় হাসপাতালের বর্জ্য পায়ে লেগে যায়।এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আগে জানতে এখানে ভর্তি হতাম না।
আলতাফ হোসেন নামের আরেক রোগী বলেন, টয়লেটেও তো যাওয়ার কোন ব্যবস্থাই নেই। অনেক মানুষ, সে তুলনায় টয়লেট কম। টয়লেটগুলো দিনে একবার পরিষ্কার করার পরপরই নোংরা হয়ে যায়। তাই দিনে কয়েকবার পরিষ্কার করা উচিত।
হাসপাতালে কয়েকজন শিক্ষার্থী সময়ের আলোকে জানান, যত্রযত্র ময়লা-আবজর্না ও বিকট দুগর্ন্ধে তারা ঠিকমতো চলাফেরা ও প্যাক্টিক্যাল ক্লাসসহ করতেও সমস্যা হয়। খোলা জায়গায় ফেলে রাখা এসব প্রাণঘাতী চিকিৎসা বর্জ্য অনেক ক্ষতিকর ও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকের এসব দেখা উচিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা আবর্জনা আর নোংরা পরিবেশের কারণে নাক-মুখ বন্ধ করে হাসপাতালে ঢুকতে হয়। কিন্তু কারো যেনো কোন দায় নেই। হাসপাতাল যেন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা মানুষদের অজ্ঞতা এবং বহুল ব্যবহারের কারণে ওয়ার্ডসহ ওয়াশরুমগুলো দ্রুতই নোংরা হয়ে যাচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
এ ব্যাপারে ঢামেক হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল দেশের সর্ববৃহৎ সরকারি হাসপাতাল।এখানে সারাদেশ থেকে রোগীরা আসে। আর সবসময় রোগী ও স্বজন ভিড় লেগেই থাকে। আর বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থান আছে। আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। তাহলে হাসপাতালের পরিবেশও নোংরা হবে না, আমরাও সুস্থ থাকবো।
আর রোগীদের চিকিৎসার মান আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই পরিকল্পনা ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।