ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে ৫৯ জেলায়, বরিশালেই ৪৬ শতাংশই

নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ হওয়ার শষ্কা

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।। 
দেশে চলতি আবারও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। শুধু  রাজধানীতে নয়, সারাদেশেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। একইসঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু। গত কয়েকদিনে প্রতিদিন গড়ে দেড়’শ  থেকে দু’শোর বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে  ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৫৯টি জেলায়। আর বরিশালের বরগুনা হয়ে উঠেছে রেড জোন। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে তাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে হাসপাতালগুলো।  সব মিলিয়ে  এ বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬ হাজার ২২২ জন।  আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০ জন।  মোট আক্রান্তের  ৪৫ দশমিক ৬৮  শতাংশই বরিশাল বিভাগের। তবে মৃত্যুর সংখ্যায় এগিয়ে ঢাকা বিভাগে। দুই সিটিতে মিলিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। যার ৫০ শতাংশই ঢাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এর পরেই বরিশালে বিভাগে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ গত বছর এ্ই সময়ে ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২১১ জন। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার আক্রান্তে সংখ্যা দ্বিগুন। কিন্তু মৃত্যুও দিকে থেকে পিছিয়ে। গত বছর এই সময়ে মারা গিয়েছিল ৪০ জন।
একদিকে নতুন ভ্যারিয়েন্টর কারণে করোনা আতঙ্ক, অন্যদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ-দুই দিক থেকেই  জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক ও শষ্কা তৈরি হয়েছে।
এমতবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে ভ্যাপসা গরম ডেঙ্গু বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়টাকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। প্রাকৃতিকভাবে জুন থেকেই শুরু হয় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ঋতু। যদিও গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই কম-বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাই বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুর ভয়াবহ আকার ধারণ করার শষ্কা রয়েছে।
তাদের মতে, আবহাওয়া পরিস্থিতি, ঢাকার দুই সিটিতে জনপ্রতিনিধি না থাকা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতার অভাব এবং সর্বোপরি সরকারের প্রস্তুতির অভাব ডেঙ্গুর বড় সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে।স্বাস্থ্য অধিধফতরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চুয়াডাঙা, চাপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এবং  সুনামগঞ্জ বাদে দেশের বাকী ৫৯ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেশি বরগুনা জেলায়। এ্ জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৭৫০ জন। এর ধারে কাছেও নেই কোন জেলা। সবমিলিয়ে বরিশাল বিভাগের মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৪২ জন। যার শতকরা হার ৪৫ দশমিক ৬৮  শতাংশ। এর পরেই  শুধু  ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রয়েছে। এখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৪১৬ জন। এর মধ্যে যার শতকরা হার ২২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ৫৯৩ জন। যার হার শতকরা হার ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯৪৫ জন। যার শতকরা হার ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর বাইরে অন্য বিভাগগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম।
আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০ জন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৫ জন,   বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২ জন,  ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১ জন, এবং ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৩৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১১৯ জনই বরিশাল বিভাগের। যদিও এই সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি। এর আগের দিন রোববার ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৪৯ জন। এই  চলতি মাসের ১৬ দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের এবং মোট আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৮৭৭ জন। আর  সব মিলিয়ে  চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬ হাজার ২২২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ  পুরুষ এবং ৪১ শতাংশ নারী। এছাড়া এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০ জন।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩২ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৫ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৮ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫ জন এবং রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫ জন রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘন্টায়  হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৯০ জন ডেঙ্গুরোগী। আর এ বছর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৮৯ জন। এর আগের বছর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং মারা যান ৫৭৫ জন। বিগত দিনগুলোর তুলনায় এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম হলেও আক্রান্তের দ্বিগুণের বেশি।
তাই এবারে পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে নাজুক হতে পারে মনে করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ  চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. কাকলী হালদার  বলেন, গত বছর আমরা দেখেছি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে হার ভেঙ্গে যাওয়ার শরীরে ব্যথা হতো। জ¦র কম হতো। এবারও  এ ধরনের লক্ষণ দেখা গেছে রোগীদের। যেহতেু ভাইরাসের মিউটেশন হয় এবং নানা কারণে পরিবর্তন হয়। ফলে রোগ তৈরির করার ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে।তাই রোগ লক্ষণ পরিবর্তন হতে পারে। সাধারণত জ্বর থাকা অবস্থায় ডেঙ্গু রোগী মারা যায় না বা জটিলতা শুরু হয় না। বরং বিপদ শুরু হয় আসলে চার দিন পরে জ্বর কমার পর। যারা দ্বিতীয় বা তার বেশি বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন তারাই ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে বা হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তাদের আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। তবে, প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভারে রোগী সাধারণত পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যান।
তিনি বলেন, এবার  করোনা, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়াসহ বিভিন্ন ভাইরাসজনিত জ্বর  চলমান আছে। তাই  বয়স্ক মানুষ, দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং নানা কারণে যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কম তারাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাই এই সময়ে কারও জ্বর হলে কোনোভাবেই সেটাকে অবহেলা করা যাবে না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. কাকলী হালদার বলেন, আমাদের দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বিশ্বের অনেক তুলনায় খুব বেশি। কারণ আমরা মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। মশাকেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। তাই বলতে পারি ঢাকা শহরের কিংবা তার বাইরের পারিশ্বাশিক যে অবস্থা তাতে  ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোশ  বাড়তে পারে। যদি আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে সঠিক কাজ না করতে পারি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার  বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে এখন শহর থেকে গ্রামাঞ্জলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে এবং সারা বছরই  ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ডেঙ্গু একসময় শহর বা নগরের রোগ ছিল। কিন্তু আমরা গত  বছর ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। কারণ   জলবায়ুজনিত প্রভাবের কারণে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই মৌসুম ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। নির্মাণাধীন ভবন, পানি সঙ্কটের কারণে পানি ধরে রাখার প্রবণতাসহ নানা কারণে মশা জন্মায়। অনেকে বাসাবাড়িতে বালতি, ড্রামে পানি রাখেন। আমরা জরিপ করতে গিয়ে সেসব জায়গায় এডিস মশার উপস্থিতি পেয়েছি।
তিনি বলেন, এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজনন উৎস ধ্বংস করার জন্য বছরব্যাপী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।মশক নিধনের  কার্যক্রম শুধু মৌসুমকেন্দ্রিক চালালে ফল পাওয়া যাবে না। সারা বছরই করতে হবে কাজটি। তা না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।একইসঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান যুগপৎভাবে কাজ করতে হবে এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যুগপৎ পদক্ষেপ প্রয়োজন। তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com