নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে যেমন- ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। চলতি সময়ের ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে এই চারটি ধরনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তিনটি ধরণ বেশি। এর মধ্যে ডেন-১, ডেন-২ এবং ডেন-৩ সেরোটাইপ দিয়ে নতুনভাবে সংক্রমণ হচ্ছে। যার ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর বর্ষা এলেই ডেঙ্গু আতঙ্ক ফিরে আসে, এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর মধ্যে ১৬-২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বাড়ছে, যা অতীতে তুলনামূলক কম ছিল। এছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশা নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ।আবার বিশেষ করে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং কোভিড-১৯ এর নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। জুন থেকে অক্টোবর সময়কালকে ভাইরাস জ্বরের জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে।এছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হাসপাতাল ও বহির্বিভাগে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তাই রোগ নির্ণয়ে জনসচেতনতা ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) অনুষ্ঠিত একটি ‘কনটিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন’ (সিএমই) সেশনে করোনা, ডেঙ্গু জ্বরের সাম্প্রতিক প্রবণতা ‘এন ওভারভিউ অফ কারেন্ট ফিভার ট্রেন্ডস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক বিশদ আলোচনা ও পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হয়। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান তার উপস্থাপনায় ‘রিসেন্ট ট্রেন্ড ইন ফেব্রাইল ইলনেসেস ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
এদিকে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে মঙ্গলবার নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৯৪ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এটিই একদিনে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তির রেকর্ড। এর আগের দিন সোমবার দুইজনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৯২ জন। যা চলতি বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। এই নিয়ে চলতি মাসের ২৪ দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ১৯৯ জন। আর সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৪ জনে। আর এ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ৮ হাজার ৫৪৪ জনে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৫৭ জন, চট্রগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৮ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৫ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৮ জন, এবং রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৪ জন রোগী রয়েছেন।
ডেঙ্গু সংক্রান্ত উপস্থাপনায় ডা. আবেদ হোসেন জানান, দেশে এই মুহূর্তে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হচ্ছে বরিশাল ও বরগুনা এলাকায়। চলতি মাসে ১৮৭৭ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বরিশাল ও বরগুনা জেলায়। শুধু এ সপ্তাহেই বরিশালে ৫ জন ও ঢাকায় ২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
চিকুনগুনিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৭ সালের পর পুনরায় চিকুনগুনিয়ার প্রার্দুভাব বেড়েছে। দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ১৯ অক্টোবর
থেকে ২০২৫ এর ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৫২০ জন সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ১৬১ জনই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। যদিও
চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কম, কিন্তু জ্বর পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (গিটে ব্যথা, র্যাশ, দুর্বলতা) রোগীদের জীবনমানে বিস্তর দীর্ঘ¯’ায়ী প্রভাব ফেলতে পারে, তাই এটি সাধরণ ভাইরাস জ্বর ভেবে উপেক্ষা করা উচিত নয়।
কোভিড বিষয়ে ডা. আবেদ হোসেন বলেন, ২০২০ সালে করোনা মহামারী আকার নিলেও এর সংক্রমণ ঝুঁকি এখনো শেষ হয়ে যায়নি, এটি একটি পরিবর্তনশীল ভাইরাস। যা পূর্বে (আলফা, বিটা, ডেলটা অমিক্রন) ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ওমিক্রনের জেএন.১ সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি ও এক্সএফসি শনাক্ত হয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্ট দুটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ভ্যারিয়েন্ট অব মনিটরিং’ তালিকায় থাকলেও ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন নয়। এছাড়াও পূর্বের চেয়ে এবারের সেরোটাইপের সংক্রমনের হার অপেক্ষাকৃত বেশি, এমনকি আগেরবার করোনায় আক্রান্ত বা টীকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও এর ঝুঁকি রয়েছে।
অনুষ্ঠানে ‘ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫ : হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই, যদি না রোগীর দেহে নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দেখা যায়, যেমন নিউমোনিয়া।
প্রবন্ধ নিয়ে ডা. মো. নাজমুল হাসান বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের হালকা উপসর্গ যেমন ৩ থেকে ৫ দিনের জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা থাকলে রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে, যার দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রা ৩ গ্রাম। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন এবং অন্যান্য ব্যথানাশক জাতীয় ওষুধ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, কারণ এসব ওষুধ রক্তপাতের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
সতর্ক করে তিনি বলেন, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ যেমন ডেক্সামেথাসন ও হাইড্রোকরটিসন ডেঙ্গু রোগীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এসব ওষুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে এবং ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ওষুধ ডেঙ্গু চিকিৎসায় কার্যকর নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে স্টেরয়েড ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই চিকিৎসক বলেন, রোগী যদি জ্বর কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীর খারাপ বোধ করে, বারবার বমি হয়, পেটে তীব্র ব্যথা দেখা দেয়, রক্তপাত শুরু হয়, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হওয়া, মাথা ঘোরা বা চামড়া মলিন হয়ে আসে—তবে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা নিতে হবে।
নাজমুল হাসান বলেন, বর্তমানে দেশে অনেকেই ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট বাড়ানোর ঘরোয়া পদ্ধতি হিসেবে পেঁপে পাতার রস ব্যবহার করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়, এই ধারণার পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। পেঁপে পাতার রস অতিরিক্ত বা ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা এমনকি লিভারের সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। এটি ডেঙ্গু চিকিৎসার কোনো বিকল্প নয়। প্লাটিলেট বাড়াতে পেঁপে পাতার ওপর নির্ভর না করে বিশ্রাম, তরল খাবার ও চিকিৎসকের পরামর্শমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
প্লাটিলেট প্রসঙ্গে বলেন, একজন ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন কেবল তখনই প্রয়োজন হয় যখন রোগীর প্লাটিলেট সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নামে, রক্তপাত দেখা দেয় অথবা কোনো অপারেশন বা ইনভেসিভ প্রসিডিউরের প্রয়োজন পড়ে। শুধুমাত্র প্লাটিলেট কম থাকার কারণে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক হতে পারে। হিমোগ্লোবিন খুব কমে গেলে বা রক্তপাতজনিত শক দেখা দিলে সম্পূর্ণ রক্ত বা রেড ব্লাড সেল ট্রান্সফিউশন বিবেচনা করা যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। সভাপতিত্ব করেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ। এছাড়াও উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং রেডিডেন্টরা উপস্থিত ছিলেন।