ডেঙ্গুতে মৃত্যু দুই’শ ছাড়াল, ঢাকাতেই ৭১ শতাংশ

‘হাসপাতালে দেরিতে ভর্তি হওয়ার মৃত্যুর হার বাড়ছে'

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।। 

দেশে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে ডেঙ্গু। শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের অন্যান্য জেলাতেও বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এরই মধ্যে চলতি বছরে মৃত্যুর সংখ্যা দু’শো এবং আক্রান্তের সংখ্যাও ছাড়িয়েছে ৪০ হাজারে বেশি। আর এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। মোট মৃত্যুর প্রায় ৭১ শতাংশ এবং মোট আক্রান্তের ৫৭ শতাংশই এই বিভাগে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মৃত্যু হয়েছে ৫৩ শতাংশের। এছাড়াও রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘাটতির অভাব রয়েছে।  তাই  প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার বাড়ছে।  সবার সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।  এছাড়াও  রোগীদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি থাকায় হাসপাতালে দেরিতে আসছে। ফলে মৃত্যুর হার বাড়ছে। তবে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে গত ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর শুক্রবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪’শ ৯০ জন। সব মিলিয়ে এ বছরে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ২০১ জনে এবং মোট আক্রান্ত হলো ৪০ হাজার ৮৯৫ জন। তবে মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে ঢাকার বিভাগ। এ মোট মৃত্যুর ১৪২ জনই এ বিভাগের। সিটি কর্পোরেশনসহ ঢাকা বিভাগে মোট মৃত্যুর ৭০ দশমিক ৬৫ শতাংশই মৃত্যু এই বিভাগে।   এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মৃত্যু হয়েছে ১০৭ জনের। অর্থাৎ ৫৩ দশমিক ২৩ শতাংশ মৃত্যু। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মৃত্যু হয়েছে  ২৮ জনের। অর্থাৎ এ সিটিতে মৃত্যু হয়েছে ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। অর্থাৎ মৃত্যুর ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এছাড়াও বরিশাল বিভাগে সিটি করপোরেশসহ মোট মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের যা ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ, চট্রগ্রাম বিভাগে সিটি করপোরেশনসহ মোট মৃত্যু হয়েছে  ২২ জনের, যা ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। খুলনা বিভাগে সিটি করপোরেশনসহ মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের, যা ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ময়মনসিংহ এবং রংপুর বিভাগে একজন করে মৃত্যু হয়েছে।
আক্রান্তদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিটি কর্পোরেশনসহ ঢাকা বিভাগে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ৪৫৪ জন। অর্থাৎ ৫৭  দমমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৮ হাজর ৮৭৭ জন। অর্থাৎ ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ । আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৩১৮ জন অর্থাৎ ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ। চট্রগ্রাম বিভাগে সিটি করপোরেশনসহ মোট আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ৯০৪
জন, যা ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে সিটি করপোরেশসহ মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৪৭ জন যা ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, খুলনা বিভাগে সিটি করপোরেশনসহ আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ২০৫  জন, যা ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে এক হাজার ৪৯ জন। অর্থাৎ  ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া অন্য বিভাগগুলো মধ্যে রাজশাহীতে ৯’শ ৯২ জন, রংপুরে ৬১৭ জন এবং সিলেপ বিভাগে ৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলায় হয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন তিন হাজার ৫২২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি এক হাজার ৭৩৩ জন এবং ঢাকার বাইরে রয়েছেন এক হাজার ৭৮৯ জন। আর গত ২৪ ঘন্টায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪৬১ জন। আর এ  বছরে ডেঙ্গুতে মোট ৩৭ হাজার ১৭২ জন  ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে,  দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড। যা আগে কখন দেখা যায়নি। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩৩৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১১ জন; যাদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিল মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুইজনের। মে মাসে ৬৪৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুন মাসে ৭৯৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের এবং জুলাই মাসে ২৬৬৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ জনের।
যদিও চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ১০টি সমন্বয়ক ও তদারক কমিটি। প্রতিটি কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৭ জন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ কর্মকর্তা রয়েছেন। মশক নিধন অভিযান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সকল সিটি কর্পোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভায় কাজ করছে ৩ হাজার ২১৪ জন মশককর্মী।  এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৪টি টিম এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৩টি টিম কাজ করছে। তবুও কমছে না ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব। একইসঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা, রাজধানীর ঢাকা ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ।
ডেঙ্গুর সার্বিক কার্যক্রম প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির  বলেন,  এবার অসময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে যার ফলে আমাদের কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে একটি ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন,স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে সংখ্যা দেয়া হয় তা হাসপাতালের রোগি কেন্দ্রীক। দেশের সবচেয়ে বড় বড় হাসপাতালগুলোর অবস্থান ডিএসসিসিতে হওয়ায় এখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখানো হয়। এরপরও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিধনে আমাদের কার্যক্রম সঠিকভাবেই চলছে।
ডেঙ্গুর বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের  সহকারী অধ্যাপক ডা. মো সাইফুল্লাহ  বলেন, ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মশা কামড়ানোর চার থেকে সাত দিন পর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। এই সময়ে বিরামহীন মাথাব্যথা, হাড় ও হাড়ের পেশিতে তীব্র ব্যথা, বমি ভাব, বমি হওয়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। আগের আমরা দেখেছি শরীরে জ্বর ও সর্দি-কাশি ও গলা ব্যথার পরিমাণ একটু কম থাকতো। কিন্তু এবার রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে।  আর এবার যারা আক্রান্ত হচ্ছেন  তাদের অধিকাংশই ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ফিভারে (অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ) ভুগছিলেন। আর এধরনের রোগীদের বাচাঁনো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এ রকম অবনতি দেখলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ খাবেন না। এছাড়াও এই সময়ে  জ¦র হলে অবহেলা করা যাবে না। কারণ হাসপাতালে দেরি ভর্তি কিংবা চিকিৎসার কারণে অনেকের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার  বলেন, বিগত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে-মৌসুমের পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে কারিগরিভাবে সঠিক ও বাস্তবায়নযোগ্য একটি কর্মকৌশল দ্রুত প্রণয়ন করা জরুরী। ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে সার্ভিলেন্স কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। মশার প্রজননস্থানগুলো ধ্বংস করাসহ হটস্পটগুলোতে উড়ন্ত মশা মারার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু কখনোই নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com