নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে দেশে। কেবল রাজধানীরই নয় ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের বরগুনায় ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে উঠছে। আর সংক্রমণ বাড়ার আশংকার মধ্যেই গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এবছরে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর মধ্যে চারজনই বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা এবং একজন ঢাকার। আর শুক্রবার নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫৯ জন। আক্রান্তের মধ্যে ১২৪ জনই বরিশাল বিভাগের। তার মধ্যে আবার ৬৭ জনই বরগুনার।
বরগুনা ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে ওঠার কা কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিসের লার্ভা ও মশার ঘনত্ব বেশি থাকায় এবং এডিস মশা নিধন না করায় প্রকোপ বেশি দেখা দিয়েছে। এছাড়াও জনসংখ্যাও এবং উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় লবণাক্ততা বেশি হওয়ায় ডেঙ্গুর বিস্তৃতি ঘটছে। ফলে মশক নিধন না করলে প্রকোপ আরও বাড়ার আশংকা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৫ হাজার ৫৭০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২ হাজার ৪’শ ৮৮ জন। যার শতকরা হার ৪৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আক্রান্তের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি। এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৮৪৯ জন। যার শতকরা হার ১৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৪৭ জন। যার শতকরা হার ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মিলিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ২৯৫ জন। যার শতকরা হার ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর বাইরে অন্য বিভাগগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা এক’শর কম। মোট আক্রান্তের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী।
আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৪ জন, বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১ জন, এবং ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের বছর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং মারা গেছেন ৫৭৫ জন।
শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি মাসের ১৩ দিনে মোট আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ২২৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার মৃত্যু শূন্য দিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১০৮ জন। সব মিলিয়ে আর এ বছর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫ হাজার ১১ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১২ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩ জন এবং সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জন রয়েছেন।এসময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১০৪ জন ডেঙ্গুরোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা শীত-গ্রীষ্ম মানছে না। বছরব্যাপী প্রজনন এবং বংশবিস্তার করছে। এসব কারণেই দেশে এখন ডেঙ্গু সংক্রমণ সারা বছর ধরেই চলছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, অতীতে শহরের বাসা-বাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপটাই) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটালেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে। আবার সারাদেশেই মশক নিধন ঢিমেতালে চলেছে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে।
বরগুনার ডেঙ্গু পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, এ জেলার পরিস্থিতি খারাপ হবে বিষয়টি জানুয়ারিতেই প্রশাসনকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এডিস মশা নিধন না করলে প্রকোপ বাড়বে এটা স্বাভাবিক। আমরা দেখেছি সেখানকার মানুষজন রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য বালতি কিংবা ড্রামে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যখন আমরা মানুষকে বলেছি, এই পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। তখন তারা বলেন, সেগুলো লার্ভা নয়, পানির পোকা। তারা বিশ্বাসই করেননি, সেগুলো এডিস মশা। আবার উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় লবণাক্ততা বেশি। সে কারণে ওই জেলায় যতদিন পানির সংকটের সমাধান করা যাবে না, ততদিন ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া নাগরিকদের সচেতন করতে হবে।শা
বরিশাল ব্যুরো জানায়:
বরিশাল বিভাগের চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মারা যাওয়া ৭ জনের ৫ জনই বরগুনা জেলার। ডেঙ্গুর প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে ইতিমধ্যে নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় প্রশাসন। গুরুত্বপূর্ণ অশিংজনদের নিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যক্রম চলছে বরগুনায়।
বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছরের শুরু থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে দুই হাজার ৫৮৩ জন। এর মধ্যে বরগুনা জেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৪১০ জন। একই সময়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে দুই হাজার ২৩৮ রোগী। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৩৩৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালে ৭৪ জন, বরিশাল শের ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে ২১ জন এবং পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। তবে ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠী জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে কেউ ভর্তি হয়নি। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ৮৩ জন।
বরগুনা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রেজওয়ানুর আলম বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে সভা হয়েছে। ইতিমধ্যে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্স সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, আরও বৃদ্ধি করা হবে। আমরা সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বরগুনায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করছি।
বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। রোগী রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।