চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল, শনাক্তের বাইরে ৮২ শতাংশ রোগী

বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস আজ

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।। 
ঢাকার উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা দশম শ্রেণীর ছাত্র সাদিয়ান (১৬) , তার ছোটভাই সায়ান (৬) প্লে গ্রুপের ছাত্র। তারা দুইজনই জন্মের পর থেকেই হিমোফিলিয়া বা রক্তক্ষরণজনিত রোগের আক্রান্ত। তাদের বাবার সরফরাজ হিমোফিলিয়া রোগ না থাকলেও দুই ছেলে শিশু বয়স থেকেই এ রোগে আক্রান্ত।  শরীরে কালচে দাগ হয়, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তপাত শুরু হলে আর বন্ধ হয় না। হাঁটু, কনুই এবং  শরীরের অন্যান্য ফুলে যায়। রক্ত জমাট বাঁধা বা প্রোটিনের মাত্রা কমে গেলে প্রতি মাসে কয়েকবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়।  চিকিৎসকের পরামর্শে মাসে মাসে ইনজেকশন (ফ্যাক্টর) নিতে হয়। যার মূল্য ১০ হাজার টাকা। আবার রক্তের প্লাজমাও নিতে হয়। দুই ছেলের জন্য কোন মাসে ৫০ হাজার টাকা আবার কোন মাসে তার চেয়েও বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আমার সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে এ ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বজনদের সহযোগিতায় কোন রকমে ধার   করে চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
দীর্ঘমেয়াদী ও চিকিৎসা খরচ ব্যয়বহুল হওয়ায় হিমোফিলিয়া রোগে শুধু এই পরিবার নয়, তাদের  মতো আরও অসংখ্য পরিবার এই চিকিৎসা করাতে গিয়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছেন।
চিকিৎসকদের তথ্যমতে, হিমোফিলিয়া অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ জনিত রোগ। বংশগত রোগ যা জিন দ্বারা উত্তর প্রজন্মে পরিবাহিত হয়। এ রোগ পুরুষের হলেও বাহক নারী। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাবা রোগী ও মা বাহক হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। হিমোফিলিয়া রোগীর সঙ্গে আত্মীয় যেমন খালাতো, মামাতো বা ফুপাতো বোনের বিয়ে হলে দুজনেই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আক্রান্তদের রক্ত জমাট বাঁধে না। ছোট-খাটো আঘাত বা কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণে মৃত্যু হতে পারে। শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত হয়। শরীরের নিয়মেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই রক্তপাত থেমেও যায়। রক্ত জমাট বাঁধতে কাজ করে প্লেটলেট সহ নানারকম ফ্যাক্টর। মানুষের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার জন্য অণুচক্রিকা ছাড়াও ১৩টি ফ্যাক্টর থাকে। এর মধ্যে ফ্যাক্টর-৮ ও ৯ অনুপস্থিত থাকলে এ রোগ হয়। এ রোগের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, ক্রাইয়োপ্রিসিপিটেট (রক্ত থেকে তৈরি উপাদান) বা কগোলেশন ফ্যাক্টর নামে দুই ধরনের ইনজেকশনের মাধ্যমে এর চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়ার তথ্য মতে,  বিশ্বে প্রতি দশ হাজার মানুষের মধ্যে একজন হিমোফিলিয়ায় (রক্তরোগ) আক্রান্ত হয়। , বিশ্বে প্রতি লক্ষ নবজাতক পুরুষ শিশুদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৬ জন হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ৫ জন হিমোফিলিয়া ‘বি’ রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে ৯ দশমিক ৫ জন হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ১ দশমিক ৫ জন হিমোফিলিয়া ‘বি’ রোগে  আক্রান্ত, শিশুরা তীব্র মাত্রার রোগে আক্রান্ত। আর বাংলাদেশে প্রতি লাখে ১০ জন মানুষ হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত। সে হিসাবে দেশে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা হওয়ার কথা প্রায় ১৭ হাজার। কিন্তু দেশে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ২০০ এরও বেশি হিমোফিলিয়া রোগী রেজিস্টার্ড হয়েছেন। অর্থাৎ  ১৮ শতাংশ  রোগী চিকিৎসার আওতায়  আসলেও প্রায় ৮২ শতাংশই এখনো শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছে। এমন প্রেক্ষিতে আজ বুধবার বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। এবারে দিবসটি প্রতিপাদ্য  দিবসটির ‘সকল রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করুন’।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের অধিকাংশই হিমোফিলিয়া রোগী গ্রামাঞ্চল ও জেলা পর্যায়ের। তবে এ রোগের চিকিৎসা কেবলমাত্র রাজধানীকেন্দ্রিক। এ কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীদের। মাত্রাতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পেরে চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন বেশিরভাগ রোগীই। কারণ দেশে আক্রান্ত রোগীর ফ্যাক্টরগুলো আসে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়ার মাধ্যমে। এ ছাড়া দেশে কিছু সেন্টার রয়েছে, যেখানে হেমাটোলজি বিভাগ রয়েছে। যেমন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, শিশু হাসপাতাল ও ল্যাব ওয়ান ফাউন্ডেশন। এখানে অলাভজনকভাবে রোগীদের ফ্যাক্টর ও প্লাজমা দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাজশাহী, রংপুর ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পাওয়া যায়। তাই দেশে হিমোফিলিয়ার সকল রোগী যেন সহজে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক, জরুরি চিকিৎসা এবং সুলভে ফ্যাক্টর, প্লাজমা এবং অন্যান্য চিকিৎসার উপকরণ পেতে পারেন সে ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শও দেন বিশেষজ্ঞরা।

হিমোফিলিয়া আক্রান্ত ভুক্তভোগী রোগী গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আমির হোসেন (৩৭)  বলেন, শিশু বয়স থেকেই এই রোগে ভুগছি। তবে আমার দুই ছেলের এই রোগ  না হলেও বোনের এক ছেলে এই রোগ পেয়েছে।
তিনি বলেন, এখন সৃজন পরিবর্তন হলে সমস্যা বেশি দেখা দেয়। শরীর ফুলে যায় এবং প্রোটিনের মাত্রা কমে যায়। কোন কাজ করতে পারি না। তখন ইনজেকশন নিতে হয়। আমার প্রতিমাসে ওষুধপত্রসহ কমপক্ষে ৫ হাজার টাকার বেশি লাগে।  চিকিৎসার খরচ যোগার করতে গিয়ে জমি-জমা যা ছিল বিক্রি করে পুরো পরিবার নি:স্ব হয়ে  গেছে। বাচ্চাদের পড়াশোনাও ঠিকভাবে করাতে পারছি না। স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে কোনোভাবে চিকিৎসা চলছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আর কত নিবো। হাত পাতলেও লজ্জা লাগে। আবার অনেক সময় ঠিকভাবে রক্তের  প্লাজমা ডোনার পাওয়া যায়না। বিভিন্ন হাসপাতাল এবং সোসাইটিতে দৌড়াদৌড়ি করে অনেক টাকা পয়সা খরচ করে সংগ্রহ করতে। কত যে কষ্টে আছি তা কাউকে বোঝাতে পারবো না।

হিমোফিলিয়া  রোগের ভয়াবহতা সর্ম্পকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হেমোটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অখিল রঞ্জন বিশ্বাস  বলেন,  অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ থেকে সাবধান থাকাই এই রোগের প্রধান চিকিৎসা। তাই আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ  মেনে চলতে হয়। একজন রোগীর  চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ফ্যাক্টরগুলো ব্যবহৃত হয় তা খুব দামী। তা যদি সঠিকভাবে না দেওয়া হয় তখন রোগীর বার বার রক্তক্ষরণ হবে। জয়েন্ট এবং মাংশপেশীতে বার বার  রক্তক্ষরণ হলে এক সময় পঙ্গুত্ব হয়ে যায়। আবার ব্রেনে ও গলার মধ্যে হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে।

দেশে এ রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত  ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, পঙ্গু হওয়ার আগেই শরীরে যে ফ্যাক্টরগুলো ঘাটতি থাকে তা সপ্তাহে দুই/একদিন নিদিষ্ট মাত্রায় দিতে হবে। যাতে করে ফ্যাক্টরগুলো না কমে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার ও চিকিৎসার খরচ বেশি হওয়ার কারণে রোগীরা তা দিতে পারে না। রোগীদের  ব্লিডিও হওয়ার আগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে  সরকারি হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি অর্গানেজাইশনেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। ফ্যাক্টরের ঘাটতি রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে থেকে ফ্যাক্টরগুলো আমদানি করা হয় না। দুই/একটা কোম্পানি আদমানি করে কিন্তু দামও বেশি। যা অনেক রোগীর সাধ্যের বাইরে। আর এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল হওয়ায় মোট আক্রান্তের বড় অংশই চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
হিমোফিলিয়া রোগীদের শনাক্তের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে  বিএসএমএমইউর হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দিন শাহ বলেন, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বা কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়াটাই হিমোফিলিয়ার মূল লক্ষণ। শিশু বয়সেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। মৃদু হিমোফিলিয়া রোগীর ক্ষেত্রে তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। বারবার রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে গিরায় ক্ষয় এবং বিকৃতি দেখা দিতে পারে। এছাড়া স্পর্শকাতর অংশে যেমন মস্তিষ্ক, খাদ্যনালি, মেরুদণ্ড) রক্তক্ষরণ হলে জীবন বিনাশের বা স্থায়ী অক্ষমতার ঝুঁকি তৈরি হয়।
তিনি বলেন,‘হিমোফিলিয়া রোগী কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সাধারণত তারা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত থাকে।  এদের বিয়ের আগে এবং বিয়ের পরে কাউন্সেলিং প্রয়োজন হয়। সেই কাউন্সেলিং ব্যবস্থাও আমাদের নেই। তাই  এই রোগ  প্রতিরোধের উপায় হলো ডায়াগনসিস, চিকিৎসা, আরেকটা হলো রিহ্যাবিলিটেশন, মানসিক সাপোর্ট ও থেরাপির ব্যবস্থা করা। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com