চিকিৎসার আওতার বাইরে ৮২ শতাংশ নারী

আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা নির্মূল’ দিবস আজ   

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

তের বছর ধরে  ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন গাজীপুরের আমেনা বেগম (৩৫)। তার বয়স যখন ২৫ বছর তখন প্রথম বাচ্চা সিজার করতে গিয়ে এই রোগের সৃষ্টি হয়। আমেনা বেগম  বলেন, আমার প্রসব ব্যথার উঠার তিনদিনের মাথায়  একটি বেসরকারি ক্লিনিকে  নেওয়া হয়। সেখানে ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে এই রোগ হয়। ততক্ষণে পেটের বাচ্চাটিও মারা যায়। এরপর আর সন্তান হয়নি। তিনি বলেন, আমি এখন সুস্থ হলেও সন্তান নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে। ক্লিনিকের ডাক্তার ও আমাদের ভুলের কারণে আজ আমি সন্তান হারা। একটু সচেতন হলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। এমনভাবে ধুঁকতে হতো না। আমার সংসারটা পরির্পূণ থাকতো। ফিস্টুলায় আক্রান্ত একাধিক নারী জানান, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অভিশপ্ত ও দূ:সহ জীবন পার করতে হচ্ছে তাদের। কারণ আক্রান্ত হওয়ার পর বাচ্চাদের মতোন বিছানায় রাবার ক্লথ বিছানো লাগে, সারাক্ষণ ভিজে থাকে কাপড়, কোথাও বসা যায় না, গন্ধে কেউ কাছে আসে না। স্বামী ছেড়ে গেছে অনেক আগেই, নিজের মা পর্যন্ত দূর দূর করে। সবার চোখে-মুখে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে। আবার অনেক নারীদের মাতৃত্বের সুখ কেড়ে নিয়ে নিয়েছে। ফলে অনেকের  জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে ফিস্টুলা নামক সমস্যার কারণে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রসবজনিত কারণে মারা যান ১৪ জন নারী। আর এই ১৪ জন নারীর মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ নারীর মৃত্যু হয় বাধাগ্রস্ত বা বিলম্বিত প্রসবের কারণে। তবে বাংলাদেশে ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা কত- এ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই।ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা সার্জনসের (আইএসওএফএস) তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর অনুমিত সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৫৭ জন। এর মধ্যে অস্ত্রোপচার হয়েছে ৩ হাজার ১০৯ জনের। অর্থাৎ ৮২ শতাংশ নারী চিকিৎসার আওতার বাইরে আছেন।যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক এক লাখ ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। প্রতি এক হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে এক দশমিক ৬৯ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত।

চিকিৎসকদের মতে, প্রসব ব্যথা ১২ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হলে বা বিলম্বিত প্রসবের সময় সন্তানের মাথা জরায়ুর মুখে আটকে থাকার ফলে মূত্রথলী এবং পায়ুপথ চাপের মধ্যে থাকে। ফলে এইসব জায়গায় রক্ত চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং পচন ধরে এবং কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে ফুটো তৈরি হয়। মূত্রথলী ও যোনী পথের মধ্যে অস্বাভাবিক সংযোগ হলে তাকে ভেসিকোভ্যাজিনাল ফিস্টুলা (ভিভিএফ) এবং পায়ুপথ ও যোনী পথের মধ্যে সংযোগ হলে তাকে রেকটোভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা (আরভিএফ) বলা হয়। আবার পায়ুপথের রোগ ফিস্টুলা। এটি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ফিস্টুলায় মলদ্বারের পাশে ছোট ছিদ্র তৈরি হয়, যা দিয়ে পুঁজ-পানির মতো বের হতে থাকে। সাধারণত নালিটি পায়ুপথের কতটা গভীরে প্রবেশ তার ওপর নির্ভর করে জটিলতা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,নারীর অপুষ্টি, অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ, অপ্রশিক্ষিত দাইয়ের হাতে বাড়িতে সন্তান প্রসব এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব ফিস্টুলা রোগের অন্যতম কারণ। এ সমস্যায় অনেক নারী ভুগে থাকলেও নারীদের সঠিক ধারণার অভাবে কমছে না ফিস্টুলার মতো রোগ। এটি নারী বা মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ফিস্টুলা রোগীর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তারা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে অবহেলা ও অবমাননার শিকার হন। আবার অনেকের ভুল ধারণা আছে, ফিস্টুলা অস্ত্রোপচারে পুরোপুরি সারে না। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। ফিস্টুলা অস্ত্রোপচারে সফলতার হার ৯৫ শতাংশের বেশি। তাই সবাইকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ ‘আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা নির্মূল’ দিবস।

জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় ফিস্টুলা সেন্টারসহ দেশের ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর মধ্যে ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ প্রসূতি ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সে প্রথম প্রসব করেছিলেন। ফিস্টুলা রোগীর মধ্যে ৩০ দশমিক ৪ শতাংশের বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪৯ বছর, ৫০ বছরের বেশি ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ২৬ দশমিক ১ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৯ বছর, ৮ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর। এসব রোগীর ৭৯ দশমিক ৩ শতাংশের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দেশের ১৮টি হাসপাতালে ভর্তি ৭১৯ জন ফিস্টুলা রোগীর ওপর চালানো এই গবেষণার ফলাফলে গড়ে ১৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর এসব রোগীর ৭০ শতাংশ পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে বলেও জানানো হয়।

এছাড়াও জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রসবজনিত (বাধাগ্রস্ত প্রসব) কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্তদের হার ৫৭ শতাংশ।  আর জরায়ু অপসারণ করতে যে অস্ত্রোপচার হয়, সেক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ এবং অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের পরবর্তী আঘাতের কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন ৪০শতাংশ নারী ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল ও কলোরেক্টাল সার্জন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক  ডা. মো. নাজমুল হক মাসুম বলেন,  ফিস্টুলা  সমস্যার সমস্যার অনেক নারীরা প্রচন্ড সমস্যায় পড়েন।এটা মূলত বিলম্বের কারণে এই রোগ হয়। আর এই সমস্যা হলে মেয়েদের মাসিকের রাস্তার সাথে পেশাবের রাস্তার সংযোগ হয়ে যায়। ছিদ্র হয়ে যায়। তখন অনেকের মাসিকের রাস্তা দিয়ে পেশাব চলে আসে। এমনকি পায়খানাও চলে আসে। আর সব সময় পেশার ঝরতে থাকে। তখন আশ-পাশের মানুষ তার কাছে বসতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীও চলে যায় এবং ডিভোর্স হয়ে যায়। ফলে নারীদের শাররিক ও মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 তিনি বলেন, এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মানুষকে সচেতন হতে হবে। বাসা বাড়িতে  দাই মা দিয়ে সন্তান প্রসব করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তান প্রসবের সময় যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলে  প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেকের ভুল ধারণা আছে, ফিস্টুলা হলে তার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, এই রোগের কোন চিকিৎসা নাইএমনটি সঠিক নয়। রোগ নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নাই। যারা  ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করে তাদের শরণাপন্ন হতে হবে। ফিস্টুলা রোগের  অস্ত্রোপচার করলে তার সফলতার হার ৯৫ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ অধিকাংশ রোগী একেবারেই ভালো হয়ে যান। তবে জটিল ফিস্টুলার একাধিক ধাপে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।

ফিস্টুলা শুধু রোগ নয়, এটি একটি দুর্যোগ উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অবস এন্ড গাইনি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বেগম নাসরীন  বলেন, মূলত দুই কারণে ফিস্টুলা হয়ে থাকে। এক হলো -নরমাল ডেলিভারি হতে গেলে বাচ্চার মাথা অনেক সময়  আটকে যায়। তখন বাচ্চার মাথার চাপে মায়ের  জননাঙ্গের টিস্যুগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে টিস্যুগুলো মারা যায় এবং একটি ছিদ্র তৈরি হয়। এমন অবস্থায় অধিকাংশ নারী মৃত সন্তান প্রসব করেন। এক পর্যায়ে মাসিকের রাস্তার সাথে পেশাবের রাস্তার সংযোগ হয়ে যায় এবং নিয়মিত প্রস্রাব ঝরতে থাকে। দ্বিতীয় কারণ হলো অপারেশন বা সার্জারি। অনেক সময়  দেখা গেছে, বাচ্চার মাথা যখন নিচে নেমে যায় তখন মাথা উঠাতে গিয়ে ব্লাডার ফুটো হয়ে। তখন  অনেক অনভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নতুন নতুন ডাক্তার তখন বুঝতে পারে না। সাথে সাথে সেলাই করে দেয়। কিন্তু রোগীর যে ফুটো গেছে বুঝতে পারে না।  আবার গ্রামে গঞ্জে অপারেশ করা হয়।  অভিজ্ঞ ডাক্তার -নার্স নাই। সঠিক নিয়মে অপারেশন করা হচ্ছে না। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে। ফলে দিন দিন  অপারেশন করতে  গিয়ে  ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

তিনি বলেন, প্রায় সব ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারী শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হন। প্রথমে স্বামী, পরে সন্তানসহ পরিবার এবং এক সময় সমাজ তাঁকে এড়িয়ে চলে। নারীরা দিশাহারা হয়ে পড়েন। আবার যে সব নারী আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই সাধারণত দরিদ্র এবং চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

সঠিক চিকিৎসায় ফিস্টুলা ভালো হয় উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, মূলত  অপারেশন ছাড়া এই রোগ সাধারণত ভালো হয় না। কিন্তু অনেকেই অপারেশনকে ভয় পেয়ে ‘বিনা অপারেশনে চিকিৎসা’- এই নামে হাতুড়ে চিকিৎসকের চিকিৎসা নিয়ে অনেক ক্ষতি করে ফেলেন। অপারেশনের পরের যত্ন বা পরিচর্যার উপর ফিস্টুলা অপারেশনের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। এই রোগ নিয়ে লজ্জা না পেয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা ভালো। সচেতনতার উপর আরও ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com