নিজস্ব প্রতিবেদক।।
দিনভর চিকিৎসকদের কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনেও রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে দিনভর চরম ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং স্বজনদের। ‘শর্ত সাপেক্ষে’ সীমিত পরিসরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি সেবা চালু থাকলেও বহির্বিভাগ ও রুটিন সেবা চালু ছিল বন্ধ। চালু করা হয়নি টিকেট কাউন্টার। তাতে করে জরুরি বিভাগে রোগীর চাপ পড়ে। আবার অনেক চিকিৎসকদের অনেক রুমে ঝুলছিল তালা। ফলে অপেক্ষমাণ রোগী ও স্বজনদের চরম বিপাকে পড়তে হয়। আবার সেবা না পেয়ে অনেককে ফিরেও যেতে দেখা গেছে। আর স্বজন, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে আসছিলে তাদের অনেকেই চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতি ও আন্দোলনের খবর জানতেন না তাদেরকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
সোমবার সকাল থেকে দুপুড় ১টা পর্যন্ত রোগীর উপছে পড়া ভির দেখা যায়। যা অন্য দিনের তুলনায় তিনগুন। আর রোগীর চাপ বাড়ায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের। জরুরী বিভাগের সামনে সকাল থেকে সেনাবাহিনী এপিসি গাড়ি নিয়ে পাহাড়া দিতে দেখা গেছে । এছাড়াও হাসপাতালের ভিতরে সেনা বিজিবির পাহারায় সেবা কার্যক্রম চলে।
এদিকে আবার নতুন করে দুই দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আন্দোলনরত চিকিৎসকরা।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টায় ঢামেকের কনফারেন্স রুমে মিটিং শেষে প্রশাসনিক ভবনের গেটে ডা. আবদুল আহাদ এই ঘোষণা দেন। এসময় তারা বাকি আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও স্বাস্থ্য পুলিশ কার্যকর করতে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।
আর কর্মসূচি হিসেবে আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান নেওয়ার কথা জানান তিনি। এরপর ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আউটডোরে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। এছাড়াও গত রোববার সন্ধ্যা থেকে চালু হওয়া জরুরি সেবা চলমান আছে এবং থাকবে বলেও জানান তিনি।
সোমবার সকালে সরেজমিনে ঢামেকের বহির্বিভাগে গিয়ে গেছে, টিকিট কাউন্টারে তালা ঝুলছে। কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমাণ ১০-১২ জন রোগী ও তাদের স্বজন, যারা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে এসেছেন। তাদের অনেকেই চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতি ও আন্দোলনের খবর জানতেন না।
বহির্বিভাগ থেকে সেবা না পেয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কাউকে আবার হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়।
তেমনই একজন যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তার মেয়ের চর্মরোগের জটিলতা আছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, গত দুদিন ধরে আসছি ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু, কোনো চিকিৎসককে পাইনি। এখানকার একজন নার্স জানালেন, চিকিৎসকরা আন্দোলন করছে বলে বহির্বিভাগে সেবা বন্ধ। অন্য কোনোদিন আসতে হবে।
নরসিংদির রায়পুর থেকে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের আউট আসেন রমিজ মিয়া (৩৬)। গত ১৫দিন আগে এক্সিডেন্ট করে পা ফ্যাক্চার হয়। তখন ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে ডাক্তার দেখিয়েছিলম। ১৫দিন পর ফলোআপ ছিল। সেজন্য ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি আউটডোর বন্ধ। জানতে পারলাম ডাক্তারকে মারধর করায় বন্ধ করে রেখেছে। এখন বাসায় ফিরে যাচ্ছি।
নাকের সমস্যা নিয়ে ভাগ্নি জান্নাতকে(৫) নিয়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আসেন সাথী আক্তার। তিনি মুন্সিগঞ্জ থেকে এসেছেন। সাথী বলেন গত কয়েকদিন ধরে নাকের ব্যাথায় ভুগছে জান্নাত। সকালে চিকিৎসকের কাছে আসেন। কিন্তু হাসপাতালে এসে দেখেন আউটডোর বন্ধ। পরে জরুরী বিভাগে এসে টিকিটের জন্য লাইন ধরেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মাজায় ব্যাথা নিয়ে আসেন রোগী সায়মা আক্তার (৩৮)। স্বামী ইসমাঈল হোসেন বলেন, গত এক বছর ধরে মাজার ব্যাথায় ভুগছেন তার স্ত্রী। আমরা জানতাম না হাসপাতালের আউটডোর বন্ধের কথা। সকালে এসে দেখি হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ। পরে জরুরী বিভাগে টিকিটের জন্য লাইনে দাড়িয়েছি।
চাদপুর হাইমচড় থেকে আউডডোরে আসে সোহেল (৪২)। তিনি বলেন গত একমাস ধরে আউটডোরে ডাক্তার দেখাচ্ছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে টিভিরোগ ধরা পরে। আজকে রিপোর্ট দেখাতে চাদপুর থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসি। এসে দেখি আউটডোর বন্ধ। আমিতো জানতাম না, জানলে এতদুর থেকে আসতাম না। এখন ফিরে যেতে হবে।
জরুরী বিভাগের টিকিট কাউন্টারের ইনচার্জ মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, সকাল ৮থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ৫৫০জন টিকিট নেয়। যা গতদিনের তুলনায় তিনগুন। এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে অর্ধশত। যা আগে কখনো হয়নি। আউটডোর বন্ধ থাকায় জরুরী বিভাগে রোগীর চাপ বেড়েছে।
হাসপাতালে রুটিন সেবা বন্ধ থাকায় জরুরি বিভাগ থেকেও রোগী ফিরে যেতে দেখা যায়। তেমনই একজন মরিয়ম আক্তার। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। ঢামেকে তার পিত্তথলির অস্ত্রোপচার হয়েছিল এক সপ্তাহ আগে। সেই অস্ত্রোপচারের সেলাই কাটতে তিনি ঢামেকে এসেছিলে।কিন্তু, একবার বহির্বিভাগ, আরেকবার জরুরি বিভাগ থেকে তাকে ফেরত যেতে হয়।
তিনি বলেন, আমি তিনবার বহির্বিভাগে, দুইবার জরুরি বিভাগে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। জরুরি বিভাগ থেকে বলেছে, সেলাই পরে কাটালেও চলবে।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, গত রাত থেকেই আমাদের জরুরি বিভাগের সেবা চালু হয়েছে। চিকিৎসকদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা চলছে এবং আইসিইউ ও সিসিইউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আজকের মধ্যে বাকি সেবা চালু হতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. কিশোর বলেন, সকাল থেকে রুগীদের উপছে পড়া ভির। সকাল থেকে ১পর্যন্ত ৫৫০জন টিকিট নিয়েছে। যা আগের দিনের তুলনায় তিনগুন। আউটডোর বন্ধ থাকায় জরুরী বিভাগে রোগীর চাপ বেড়েছে। রোগীদের চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের হিমসিম খেতে হচ্ছে। জরুরী বিভাগে সবসময় জরুরী রুগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। পুরাতন রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় আউটডোরে। আউটডোর বন্ধ থাকায় জরুরী বিভাগে রোগীর ভির।
এর আগে শনিবার দিনগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভাঙচুর ও চিকিৎসকদের মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে একাধিক চিকিৎসক আহত হন। রোববার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। তাদের এই কর্মসূচিতে অন্য চিকিৎসকরা সংহতি জানানোয় রোববার সকাল থেকে হাসপাতালের সব বিভাগে সেবা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। ফলে নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনরা।
দুপুরে তিন দফা দাবিতে সারাদেশের হাসপাতালগুলোয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা দেন চিকিৎসকরা। সে সময় সচিবালয়ে এক সভায় চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুরোধ জানান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূর জাহান বেগম।
পরে বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। ঘণ্টাখানেক ধরে চলা বৈঠক শেষে চিকিৎসকরা কর্মবিরতি স্থগিত করতে রাজি হন। প্রায় ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর রোববার সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের উপস্থিতিতে চালু করা হয় জরুরি বিভাগের সেবা কার্যক্রম।
এদিকে, রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোমবার সকাল থেকে জরুরি বিভাগে সেবা দেওয়া হলেও দুপুর ১২টার পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় বহির্বিভাগের সেবা কার্যক্রম।হঠাৎই বহির্বিভাগের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।
আলতাফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তবে সবকটি কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এখন আমি কোথায় যাবো, পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারছি না।
সাভার থেকে হাসপাতালে এসেছেন মহিবুল হাসুম মাসুম। তিনি বলেন, দুপুর ১টা পর্যন্ত টিকিট দেওয়ার কথা অথচ ধর্মঘটের কারণে তার আগেই সব কিছু বন্ধ।
হাসাপাতালটির আউটডোরে এক থেকে দেড় হাজার রোগী দৈনিক সেবা নেন। তবে রোববার আন্দোলন কর্মসূচির জেরে সেমাবার হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এর মাঝে দুপুর ১২টার পর থেকেই হাসপাতালটিতে আউটডোরের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হাসপাতালের সহকারী প্রধান পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এসএএম কামরুজ্জামান সূবর্ণ বলেন, আউটডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মূলত ডাক্তারদের ধর্মঘটের কারণেই আউটডোর সেবা ১২টার পর বন্ধ আছে, তবে জরুরি বিভাগে সমস্যা নাই।
এদিকে সকাল ৯টার দিকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে বহির্বিভাগ খোলা। রোগীদের টিকেট দেওয়া হচ্ছে, ডাক্তাররা রোগী দেখছেন।
হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, আমাদের ওপিডি খোলা আছে। রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।