নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশে ২০২৩ সালে মোট ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থী ২২৭ জন ( মোট শিক্ষার্থীর ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ), কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন (২৭ দশমিক ২ শতাংশ), বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯৮ জন (১৯ দশমিক ১ শতাংশ) এবং মাদ্রাসাশিক্ষার্থী ৪৮ জন (৯ দশমিক ৪ শতাংশ)। আর তাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ২০৪ জন (প্রায় ৪০ শতাংশ) এবং নারী শিক্ষার্থী ৩০৯ জন (৬০ শতাংশের বেশি)। আর শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। এসব শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল ‘অভিমান’; যা সংখ্যায় ১৬৫ জন বা ৩২ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়াও ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যা করেছেন ১৪৯ জন শিক্ষার্থী।
এদিকে, দেশে ২০২২ সালে স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল ।
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা: পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়’ শীর্ষক সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে ফাউন্ডেশনটি। দেশের ১০৫টি জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তথ্য সংকলিত করা হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আঁচল ফাউন্ডেশনের একদল গবেষকের মাধ্যমে সংগ্রহকৃত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে।
সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আত্মহত্যার কারণের মধ্যে ‘অভিমানের’ পরেই আছে ‘প্রেমঘটিত কারণ’, এ কারণে আত্মহত্যার পরিমাণ ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
এছাড়াও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, পারিবারিক কলহজনিত কারণে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
২০২৩ সালে পড়াশোনার চাপের সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ান ৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করেন ১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অপমান বোধ করে আত্মহত্যা করেন ০ দশমিক ৮।
সমীক্ষার প্রতিবেদন বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ১৪৯ জন শিক্ষার্থী। এরপরই অবস্থান করছে চট্টগ্রাম বিভাগ, এই বিভাগে আত্মহত্যা করেছেন ৮৯ জন। এছাড়াও রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনায় ৬৪ জন, বরিশাল ও রংপুর উভয় বিভাগেই ৪৩ জন করে, ময়মনসিংহে ৩৬ জন এবং সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, আত্মহত্যা করেছেন এমন ৯৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৫ জন করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬ জন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন, মেডিকেল কলেজের ৬ জন, নার্সিং ইনস্টিটিউটের ৫ জন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ২ জন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন এবং অন্যান্য ১৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় এখানে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, প্রত্যকে শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে মেন্টর (পরামর্শদাতা) নির্ধারণ করা এবং মেন্টর ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার চালু করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগীয় অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানোসহ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান বলেন, এই বয়সে আবেগজনিত সমস্যা, পড়ালেখার চাপ ও পারিবারিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের এই সমস্যাগুলো শনাক্ত করা হয় না। তাঁরা সমস্যার কথা বলার মতো জায়গাও পান না।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনায় বসা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাইদুর রহমান। যেসব প্রতিষ্ঠান আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করে তাদের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, অভিমান ও প্রেমের সম্পর্কের মতো আবেগীয় জটিলতা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের আবেগীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানের মধ্যে এবং পাঠ্যক্রমে কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, তা দেখা দরকার। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করা জরুরি। একজন শিক্ষার্থী যেন তাঁর মনের কথা খুলে বলার জায়গা পান। তিনি যেন নিজেকে বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন মনে না করেন। পড়াশোনার বাইরে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁদের মধ্যে এই বার্তা ছড়াতে হবে যে জীবন মূল্যবান এবং জীবন একটাই। জীবনে উত্থান-পতন থাকেই।
অনলাইন এ সম্মেলনে সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের টিম লিডার ফারজানা আক্তার।