নিজস্ব প্রতিবেদক।।
দেশজুড়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের পানি খাওয়ার জন্য আমার চোখের সামনে আমার চাচাকে পুলিশ গুলি করে। সাথে সাথেই ষ্পট ডেট। সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভেসে উঠে। চোখ বন্ধ করলেই চাচার জীবনের শেষ মুর্হুতের আসহায় আর্তনাত দেখতে পাই। শুধু আমার চাচা নয় চোখের সামনে কতজনকে যে পুলিশ গুলি করেছে আর কতজন যে মরেছে তার সঠিক হিসেব জানিনা। শত শত মায়ের বুক খালি হয়েছে, অনেক মানুষ হাসপাতালে কাতাচ্ছে। আমারও একটা চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। তবুও সাত্বনা যে দেশকে ‘স্বৈরাচার’ মুক্ত করেছি। জালিম সরকারের বিদায় হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এবং বহু রক্তের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি। যদি আমার আরেক চোখও নষ্ট হয়ে যেত তাহলেও আমার কোন দু:খ নেই। আমার ওই এক চোখ দিয়েই ‘নতুন’ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। এ কথাগুলো বলছিলেন ক্লাশ টেনের শিক্ষার্থী মো: আল আমিন। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চক্ষু বিভাগে ভর্তি রয়েছেন।
আল আমিন জানান, শরীরের হাতে পেটে বুকে মাথায় এখনো অসংখ্য ছররার গুলি ভেতরে রয়েছে। অসহ্য ব্যথা আর যন্ত্রণায় সব সময় কাতরাতে হয়। এক চোখ তো শেষ হয়ে গেছে। আরেক চোখে এখন আর কান্নাও আসে না। মনে হয় চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে। তার পাশেই শয্যায় শুয়ে আছেন আরেক রোগী জিসান আহমেদ (১৬)। পুলিশের গুলিতে তারও এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি জানান, এক চোখ হারিয়েছি কিন্তু বেঁচে তো আছি। আমি তো অন্ধ হয়েও যেতে পারতাম। দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যেত পারতো। এখন না হয় এক চোখ দিয়েই পৃথিবীর আলো দেখবো।বেঁচে আছি এটাই তো সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ আমার সাথে যারা আন্দোলনে নেমেছিল তাদের অনেকেই চোখের সামনে মারা গেছে। তাদের মত আমি তো মরে যেতে পারতাম।
আল- আমিনের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার কেরোয়া মানছুরা হাইস্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। বাবার নাম নজির আহমেদ এবং মায়ের নাম শিউলি বেগম। বাবা দিন মজুর। তার সামান্য আয়েই তাদের পাঁচ জনের সংসার চলে।
জানা গেছে, গত ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অসহযোগ কর্মসূচির দিন যাত্রাবাড়ি এলাকায় চাচার সাথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি খাওয়াচ্ছিলেন আল-আমিন। তখন ওই এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে এক পর্যায়ে পুলিশের সামনে তারা পড়ে যায়। তখন পুলিশ আল আমিনের চাচাকে খুব কাছ থেকে গুলি করলে সাথে সাথে মারা যায়। তখন চাচাকে উদ্ধার করতে গিয়ে আল- আমিনের হাতে পেটে মাথায় এবং বাম চোখে গুলিবিদ্ধ হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনো সেখানেই তার চিকিৎসা চলছে।
আল আমিনের ভাই নিশাদ হোসেন বলেন, এখন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক গুলি ভেতরে রয়েছে। গত ৬ আগস্ট বাম চোখে রিফ্র্যাক্টিভ সার্জারি (অস্ত্রোপচার) করা হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও চোখ ঠিক করতে পারেনি। ফলে বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। পরে ১৭ তারিখে তার চোখ তুলে ফেলা হয়। এখন পর্যন্ত কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা কারও কাছ পাননি এবং ধার-দেনা করে চিকিৎসার খরচ চলছে বলেও জানান তিনি।
তার মা শিউলি বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমি কত কষ্ট করে না খেয়ে ছেলেটারে লেখাপড়া করাচ্ছি। এখন তো তার পুরা ভবিষ্যতটাই নষ্ট করে দিলো। সরকার কি আমার ছেলের চোখ ফিরিয়ে দেবে? আমার সন্তান কি এই সুন্দর পৃথিবী ফের দেখতে পারবে? যে আঘাত পেয়েছে সুস্থ হতে পারবে কি? আর সুস্থ হলেও কি করে খাবে। আমার পোলার যে এতবড় সর্বনাশ যে করেছে আমি তার কঠিন বিচার চাই।
এক চোখ হারানো জিসানের পরিবার জানায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কুষ্টিয়া সদরে বেলা তিনটার দিকে বিজয় মিছিলে নিয়ে উৎসব করছিল শিক্ষার্থীরা। সেই মিছিল থানার কাছাকাছি গেলে পুলিশ এলোপাথারি গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে জিসানের বুকে-পিঠে, হাতে পায়ে, মাথায় এবং চোখে ১০/১৫ টা গুলি লাগে। তাকে প্রথমে কুষ্টিয়ার স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চোখের অপারেশন করা হয়। কিন্তু তার বাম চোখ আজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। তারপরে কিছু উন্নতি হলে ঢাকা মেডিকেলের চক্ষু বিভাগে ভর্তি করা হয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে জিসান সবচেয়ে বড়। সে দি ওল্ড কুষ্টিয়া হাই স্কুলের নাইনের ছাত্র। বাবার নাম সুজন মিয়া এবং মায়ের নাম হালিমা বেগম। বাবা বেঁেচ থাকলেও পরিবারের সাথে কোন ধরনের সর্ম্পক নেই। ছোট বেলায় তাদের তিন ভাইবোনকে ফেলে বাবা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছেন। তাদের মায়ের সামান্য আয়েই পুরো সংসার চলে।
জিসান বলেন, ঢাকায় আসার পর যে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম সেখানে অপারেশনের দিনই ৩০ হাজার টাকা লাগছে। আর এই সবই আত্মীয়-স্বজনদের কাছ কর্জ করা। হাসপাতালে থাকা-খাওয়া ওষুধপত্র এবং বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরিক্ষাসহ এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। সব টাকাই ঋণের। দুইজন ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য সাহায্য পেয়েছি। এছাড়া কেউ কোন ধরনের সাহায্য পাচ্ছি না। উন্নত চিকিৎসার জন্য আগামী ২৬ আগস্ট চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে যেতে হবে। বাবা থেকেই নেই বুঝতেই পারছেন, আমার মায়ের উপর কতটা ঝড় যাচ্ছে। অভাব-অনটনে আমাদের দিন পার হচ্ছে। কবে সুস্থ হবো, তা জানিনা। আর কত খরচ হবে, কিভাবে যোগাড় করে চিকিৎসা করাবো সেই দুচিন্তায় সারক্ষণ থাকি।
তিনি বলেন, গুলি খেয়ে দুটো চোখই নষ্ট হয়ে পারতো কিংবা মারাও যেতে পারতাম। মাঝে মাঝে কান্না করি। নিজেকে আজ খুব অসহায় মনে হয়। বুকের ভেতরটা ফেটে যায়। শুধু বেঁচে আছি ব্যস এইটুকই বড় সাত্বনা।
দুই পরিবারের সদস্যরাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। গণতন্ত্রের বিজয় এসেছে। নতুন বাংলাদেশ তৈরি হলো, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলো কিন্তু আমাদের কেউ খবর নিলো না। আমাদের রোগীরা হাসপাতালের বিছানায় মরণযন্ত্রনা ভোগ করছে। কোন ধরনের সাহায্য তো দূরের কথা কেউ কোনদিন খোঁজ নেওয়ারও সময় পেল না। এখন পর্যন্ত চক্ষু বিভাগে কেউ আসেনি। সবাই ক্যাজুয়ালটি বিভাগে এসে ঘুরে যায়। উপরে উঠে না। আমরা কি খাচ্ছি, কিভাবে চিকিৎসা করাচ্ছি তার খবর রাখে না। যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তা শেষ। সরকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে এটাই প্রত্যাশা আমাদের ।