নিজস্ব প্রতিবেদক।।
দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাভারের আশুলিয়ায় একটি ভ্যানে লাশের স্তূপ করছে পুলিশ—এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ও পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সাজেদুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আশুলিয়া থানা পরিদর্শনের পর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান।
আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য নামগুলো প্রকাশ করছি না। খুব শিগগিরই আপনাদের সামনে তা প্রকাশ করা হবে। মরদেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এখনো তেমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।
জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হবে কি না জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘অবশ্যই। যে অপরাধী, সে যে-ই হোক, তাঁর নামে মামলা হবে। পুলিশ আইনের বাইরে নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ছাত্র-জনতা নয়, আমাদের অনেক পুলিশ সদস্যকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার।’
কমিটিকে কত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে—প্রশ্ন করলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। হালকাভাবে নিয়ে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব, এমন নয়। বিষয়টি খুবই গুরুতর হওয়ায় যথাযথভাবে তদন্তপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দেবে কমিটি।’
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, মাথায় পুলিশের হেলমেট, সাদা পোশাকের ওপরে পুলিশের ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি আরেকজনের সহায়তায় চ্যাংদোলা করে নিথর এক যুবকের দুহাত ধরে ভ্যানের ওপর নিক্ষেপ করছেন। ভ্যানের ওপর নিথর ওই দেহের নিচে আরও বেশ কয়েকটি নিথর দেহ। সেগুলো থেকে ঝরে পড়া রক্তে সড়কের কিছু অংশ ভিজে গেছে। বিছানার চাদরের মতো একটি চাদর দিয়ে তাঁদের ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশেই পুলিশের হেলমেট, ভেস্ট পরা আরও কয়েকজনকে দেখা যায়।
সরেজমিনে ভিডিওটির আশপাশের নানা বিষয় পর্যালোচনা করে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে স্থানটি আশুলিয়া থানা লাগোয়া ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের’ পাশের সড়ক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে ঘটনাটি ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার নিকটবর্তী এলাকায় বলে উল্লেখ করেছেন।
কি ঘটেছিল সেদিন ?
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, ৫ আগস্টের দিন আন্দোলনকারীরা থানার সামনে অবস্থান নেয়। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও গুলি করে।
আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোঁড়ে।
ওই সময় সেখানে উপস্থিত থাকা স্থানীয় একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটা আশুলিয়ার থানার একদম পাশেই। পুলিশ যখন গুলি করে তখন বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এখানে সেখানে লাশগুলো পড়ে থাকে। এ অংশটুকু আমার নিজে চোখে দেখা।
তিনি জানান, একপর্যায়ে আশেপাশে পড়ে থাকা ছয়জনের লাশ পুলিশ একটা ভ্যানের মধ্যে উঠায় যেটার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। থানার সামনে দোতলা ভবনের জানালা দিয়ে একজন এই ভিডিও ধারণ করেন।
তবে, এই লাশগুলো কিভাবে পুলিশের গাড়িতে গেলো সেটা জানা যায়নি বলে জানান এই সাংবাদিক। অনেকেই ধারণা করছে পুলিশই অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার জন্য তাদের গাড়িতে লাশগুলো রেখেছিল।
তিনি বলেন, যখন আন্দোলনকারীরা থানায় হামলা চালায়, থানার সামনে আশেপাশে যত গাড়ি ছিল সবগুলোতেই আগুন ধরায়ে দিছিলে। তেমনই একটা পুলিশের গাড়িতে ছিল লাশগুলো। ওইগুলাও কিন্তু আগুনে পুড়ে যায়, একেবারেই ৬টাই।
৪ জনের পরিচয় নিশ্চিত : স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, চারজনের কাছে পরিচয়পত্র থাকায় স্বজনরা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। পরে লাশগুলো তাদের হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুইজনের পরিচয় পাওয়া না যাওয়ায় তাদের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
নিহতদের একজন গাজীপুরের একটি কলেজের শিক্ষার্থী তানজিল মাহমুদ সুজয়। তার পকেটে থাকা মানিব্যাগে পরিচয়পত্র দেখে স্বজনরা তাকে চিহ্নিত করেছে।
নিহত সুজয়ের ভাই মো: আল আমিন সরকার বলেন, শনাক্তকরণের জন্য পোড়া লাশগুলো থেকে একটা একটা করে খোলা হয়েছিল। অনেকের আত্মীয় স্বজনরা ছিল, সর্বশেষ লাশটা সুজয়ের ছিল। সাথে ওর মানিব্যাগ, আইডি কার্ড ছিল। ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় লাশ হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে আগুন দেয়ার বিষয়ে পুলিশ ও আন্দোলনকারী দুই পক্ষই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে।
তবে, পুলিশই পিকআপ গাড়িতে আগুন দিয়েছে এ রকম কোনো এভিডেন্স পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মুঈদ।
কিছু কিছু ছবি যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেটা কোন জায়গার তা বোঝা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
অনেকেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেলে ‘একটু সাইলেন্টলি সেটা নিয়ে কাজটা আগাতে হবে’ নতুবা সবাই ‘হাইড’হয়ে যাবে বলে জানান মুঈদ।
ভিডিওর পুলিশ সদস্য কারা?
পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরিহিত যে ব্যক্তি বা যারা লাশ তুলছিলেন ভ্যানে এবং আশেপাশে যারা ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের পরিচয় সম্পর্কে লেখা হয়েছে।
ইতোমধ্যেই তিনজনকে চিহ্নিত করা গিয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ।
এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনের ঘটনায় আহত, নিহতদের তালিকা হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ কতজন রয়েছেন সে বিষয়ে কোনো তালিকা হয়নি।
এদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ আন্দোলনে আহত, নিহতদের তালিকা করা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি এ তালিকা তৈরিতে সহায়তা করছে।
এ কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মো: মাসুদুজ্জামান জানান, আহত ও নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি। তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। সরকারিভাবে এ তালিকাটি করা হচ্ছে। সারা দেশের তথ্য পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে।
নিখোঁজের বিষয়ে তালিকা করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি ।