নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। একইসঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অব ক্যানসার (আইএআরসি) প্রকাশিত হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। বছরে এই রোগে মারা যায় প্রায় এক লাখ ১৭ হাজার মানুষ। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশে ক্যান্সারের বোঝা : জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রতি লাখে ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হচ্ছে ১০৬ জন। এছাড়াও প্রতি বছর নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতি লাখে হচ্ছেন ৫৩ জন। মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই ক্যানসারের রোগী। এমনকি দেশে থাকা ৩৮ ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যানসারের রোগীর সংখ্যাই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যভাস, ধুমপান ও পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে ক্যানসারে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আর এটি যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ফলে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ক্যানসারের চিকিৎসায় পিছিয়ে রয়েছে। আর যতটুকু সেবাব্যবস্থা আছে তাও রাজধানীকেন্দ্রিক। তবুও প্রাণঘাতি এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে অনেকে টিকে আছেন। বেঁচে থাকার সংগ্রামে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু পরিবার নি:স্ব হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকের পক্ষে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া অনেকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে ফলে ।তাদের বেশিরভাগই মাঝপথে চিকিৎসা নেওয়া ছেড়ে দেন। অনেকে মারা যান। আর এ জন্যই মৃত্যুও সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই ক্যানসার আক্রান্তদের বাঁচাতে ও আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধে ৯ সুপারিশ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশের প্রধান পাঁচটি ক্যানসারের মধ্যে আছে- খাদ্যনালি, ঠোঁট ও মুখ, ফুসফুস, স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসার। পুরুষের ক্ষেত্রে খাদ্যনালির আর নারীদের স্তন ক্যানসার বেশি। মৃত্যু বেশি হচ্ছে খাদ্যনালির ক্যানসারে। তাছাড়া রোগটির চিকিৎসা একক কোন চিকিৎসকের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করতে হয়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত ও সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। রেফারেল সিস্টেমে ঘাটতি থাকায় বেশিরভাগ রোগী তৃতীয় বা চতুর্থ স্টেজে (পর্যায়) সঠিক চিকিৎসকের কাছে আসছেন। এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে শয্যা ও যন্ত্রপাতি সংকটে চিকিৎসা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে বেসরকারিতে গেলেও ৯০ ভাগ রোগীর পক্ষে উচ্চমূল্যের পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। ততদিনে ক্যানসার নিরাময় কঠিন হয়ে পরে।
ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা, অনিয়ম ও অসংগতি তুলে ধরে ক্যানসার রোগতত্ত্ববিদ ও ক্যানসার প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, কোনো দেশে জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও এর কার্যকারিতা নিরূপণের জন্য ক্যানসার নিবন্ধন অপরিহার্য। ক্যানসার নিয়ে আমাদের নিজস্ব গ্রহণযোগ্য জাতীয় নিবন্ধন বা জরিপ নেই।
তিনি বলেন, বর্তমানে ক্যানসারের স্ক্রিনিং হচ্ছে মূলত হাসপাতালে। কেউ নিজে থেকে হাসপাতালে এলে এলে এই সেবা পায়। আবার অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে এসেও অনেক সময় ক্যানসার শনাক্ত হয়। এটা হলো অসংগঠিত ক্যানসার স্ক্রিনিং। প্রায় বিশ বছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পনেরো শতাংশের মতো নারীকে এর আওতায় আনা গেছে। এ জন্য সমাজভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিং কর্মসূচির বিকল্প নেই। সমাজের মানুষকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করে তাদের স্ক্রিনিং সেন্টারে আনতে হবে। জাতীয়ভাবে ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণীত ও পরিচালিত থাকলে এটা করা সম্ভব হতো।
মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আর্থ-সামজিক বিচেনায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্যানসার রোগী দিরদ্র্য, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা পরিকল্পনা ও খরচ যোগাতে বেশিরভাগ রোগী ব্যর্থ হন। আর ক্যানসার রোগীর সমন্বিত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসারের রোগ তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে এবং সেক্ষেত্রে চিকিৎসা সহজ হয়। ক্যান্সারের লক্ষণগুলি নির্ভর করে ক্যান্সারটি কোথায়, এটি কতটা বড় এবং এটি কাছাকাছি কোনও অঙ্গ বা টিস্যুকে কতটা প্রভাবিত করে। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ক্যান্সার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। কী কী কারণে ঝুঁকি বাড়ে, প্রতিরোধের জন্য কী কী করণীয় সে বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।
বিশ্ব ক্যানসার দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সোসাইটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্যানসার ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম যৌথভাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে ক্যানসার আক্রান্তদের বাঁচাতে ও আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধে ৯ সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো-জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে। একে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করতে হবে দলীয়করণ ও আমলাতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে, সব অংশীজনের সমন্বয়ে।জাতীয় ক্যানসার নিবন্ধন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে, যার আওতায় থাকবে প্রতি বিভাগীয় ক্যানসার হাসপাতাল ও অন্তত একটি করে উপজেলা। পাশাপাশি বেসরকারি ক্যানসার কেন্দ্র বা সংগঠনকে উৎসাহ ও সহযোগিতা দিতে হবে এই কাজে।সরকার, পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও সবাই মিলে তিনটি প্রধান ক্যানসার (স্তন, জরায়ুমুখ, মুখগহ্বর) স্ক্রিনিং এর জন্য জাতীয় ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।উপজেলা পর্যায়ে দুজন (একজন পুরুষ ও একজন নারী) চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজভিত্তিক ও সংগঠিত ক্যানসার স্ক্রিনিং চালু করতে হবে। প্র্যোজনে এ জন্য পদ সৃষ্টি/নির্ধারিত করতে হবে।সব অংশীজনগণকে সম্পৃক্ত করে ক্যানসার সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বাছাইকৃত বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে অর্থ বরাদ্দ কিংবা প্রণোদনা দিতে হবে।সরকারি খাতে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসা সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণ করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার দলিলে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ক্যানসারের মতো দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার দায়িত্ব মূলত সরকারের। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা বিবেচনায় নিয়ে সরকার স্ট্র্যাটেজিক পারচেজের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালে স্বল্প খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে।যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ট্যাক্স/লেভি ছাড়ের বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতালের ১০% সেবা দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত।একজন স্বজনসহ ক্যানসার রোগীদের যাতায়াত ভাড়া মওকুফ করা উচিত।