নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ঢাকার ধানমন্ডির বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটে এক শিশুর বাম চোখে সমস্যা ছিল কিন্তু তার বদলে ডান চোখে অস্ত্রপচার করেছেন চিকিৎসকরা।এমন অভিযোগ করেছেন শিশুটির স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকের ভুলে শিশুর বাম চোখের বদলে ডান চোখে অপারেশন করা হয়েছে। পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করে আবারও শিশুর বাম চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। আর এ অস্ত্রপাচার করেছেন হাসপাতালের শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং স্ট্র্যাবিসমাস সার্জন ডা. শাহেদারা বেগম। এঘটনায় রোগীর স্বজনরা মামলা দায়ের করলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালত তাকে জামিন দেয়।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুমা রহমানের আদালত তার জামিন আদেশ দেন। এর আগের দিন বুধবার শিশুর চাচা মাহফুজ নাফি জানান, তার ভাতিচা দেড় বছর বয়সী শিশু ইর্তিজা আরিজ হাসানকে চোখে ময়লা জাতীয় কোনো সমস্যার জন্য বাংলাদেশ আই হসপিটালে নেওয়া হয় । সেখানে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দেন। পরে মঙ্গলবার রাতে বাম চোখের বদলে ডান চোখে অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক।পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করে আবারও বাম চোখে অস্ত্রোপচার করেন ডা. শাহেদারা বেগম।
শিশুর চাচা মাহফুজ নাফি বলেন, আরিজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েই বাম চোখটি তুলনামূলক ফোলা এবং ভেতরে লাল হয়েছিল। কিন্তু অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করার পর শিশুটির মা-বাবা দেখতে পান বাম চোখের জায়গায় অপারেশন করা হয়েছে ডান চোখে। অথচ হাসপাতালে নেওয়ার পরও চিকিৎসকরা জানিয়েছিল শিশুটির বাম চোখের ভেতরে বাগ্স আছে। তারপরও কেন শুধু-শুধু ডান চোখে অপারেশনটি করা হলো? অথচ ডান চোখে তার কোনো সমস্যাই ছিল না। এখন তারা বলছে ডান চোখেও সমস্যা ছিল। বিষয়টি কি তাহলে তাদের চোখেই পড়েছিল? আর পড়লেই কেনই বা আমাদের না জানিয়ে ডান চোখে অপারেশনে করা হলো?’
তিনি আরও বলেন, এখন যেহেতু তারা ডান চোখে অপারেশন করেই ফেলেছে, তাই বলছে ডান চোখেও সমস্যা ছিল। এটা অবশ্যই তাদের মারাত্মক ভুল। এজন্য আমরা আইনের আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শিশু আরিজের মা ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আমি আর আমার স্বামী অপেক্ষায় ছিলাম। আরিজকে যখন ওখান থেকে বের করল, তখন জ্ঞান ফিরবে ফিরবে এমন ভাব ছিল। তার একটু পরে ওর বাবা কোলে নিয়ে বলছে, ওর তো ডান চোখে অপারেশন হয়েছে কিন্তু বাম চোখ অপারেশন করার কথা ছিল। এমন তো হতে পারে না! আজকে আমার শিশুর বড় কিছু হয়ে গেলে কী তারা চোখ ফেরত দিতে পারত?’
এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়ে শিশুর বাবা মাহমুদ হাসান বলেন, আজ আমাদের সঙ্গে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু এটা যদি বড় কোনো অপারেশন হতো তাহলে আমাদের হয়ত এখন ছেলেকে নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। এ ঘটনার সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. শাহেদারা বেগম শুরুতে অন্যান্য স্টাফদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন।
ডা. শাহেদারা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ভুলটা আসলে অন্যান্য স্টাফদের জন্য হয়েছে। বাচ্চাটিকে তারা অপারেশন টেবিলে যেভাবে তুলেছে, আমিও সেভাবে বসে গিয়েছি। তারপর চোখের পাতা উল্টাতেই দেখি একটা আইল্যাশ (পাপড়ি) আছে। যদি আমি ডান চোখে সেটি না পেতাম, তাহলে তো অবশ্যই বাম চোখ উল্টিয়ে দেখতাম। যেহেতু ওই চোখেও পেয়েছি তাই সেটি বের করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, শিশুটির দুটি চোখেই চুল পাওয়া গেছে। প্রথমে ডান চোখ থেকে চুল বের করে আনার পর রোগীর স্বজনরা বলছে যে বাম চোখে সমস্যা ছিল। তখন আমি আবার বাম চোখ পরিষ্কার করে দিয়েছি। এটি আমাদের কাছে খুবই ছোট একটি অপারেশন। তারপরও আমি ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বলছি এটা আমার ভুল।’
অস্ত্রোপচারের সময় শরীরে সারাদিনের ক্লান্তি ছিল উল্লেখ করে অভিযুক্ত চিকিৎসক আরও বলেন, আমি ওইদিন সকাল থেকেই কাজ করছিলাম। যে কারণে অপারেশন থিয়েটারে স্টাফরা যেভাবে বাচ্চাটিকে আমার সামনে দিয়েছে, আমিও সেভাবেই কাজ করে দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এখন তো আসলে অন্য স্টাফদের দোষ দিয়েও লাভ নেই।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের অন্যতম পরিচালক অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টিকে যত বড় করা হয়েছে আসলে তেমনটি নয়। তবুও আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটি রিপোর্ট দিলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কত দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি একটি মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলবো। তারপর আবার ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আহমেদ মাসুদ বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ দায়ের করলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। অপরাধী যেই হোক না কেন অভিযোগ পেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
পরে বুধবার ধানমন্ডি থানায় ভুক্তভোগী শিশু ইরতিজা আরিজ হাসানের বাবা মাহমুদ হাসান মামলাটি করেন। আর এ মামলায় বুধবার (১৫ বাংলাদেশ আই হসপিটালের শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহেদারা বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পরে বৃহস্পতিবার আসামি ড. শাহেদারা বেগমকে আদালতে হাজির করে হাজতখানায় রাখা হয়। পরে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ।শুনানি শেষে আদালত আসামিকে ৫ হাজার টাকা বন্ডে জামিন মঞ্জুর করেন।
এ সময় আসামিপক্ষ জামিন চেয়ে আবেদন করেন। এ সময় বাদীপক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, চোখে ময়লা জাতীয় কোনো বস্তুর অস্তিত্ব টের পেয়ে মঙ্গলবার হাসপাতালে দেড় বছর বয়সী ইরতিজার চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন বাবা-মা। তবে বাম চোখের বদলে ডান চোখে চিকিৎসা করা হয়। পরে দুঃখ প্রকাশ করে আবারও বাম চোখে চিকিৎসা করেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং স্ট্র্যাবিসমাস সার্জন ডা. শাহেদারা বেগম।
এদিকে, বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি গণমাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপন হয়েছে বলে দাবি করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যমে এটি অস্ত্রোপচার বলে খবর প্রচার করা হলেও মূলত চোখের পাতার নিচের পাপড়ি সরানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট এর পক্ষে চিফ অপারেটিং অফিসার কাজী মেজবাহুল আলম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই দাবি করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট এ রোগীর শিশুর ভুল চোখে অস্ত্রোপচার ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন ভিত্তিহীন ও প্রকৃত ঘটনাকে সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।