নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো অভিযোগকারী স্বজন হারানোর কথা বলছে, আবার কেউ অভিযোগ করছেন গুরুতর অসুস্থতার। এই নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। কয়েকটি দেশে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। এই টিকায় শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা এবং রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যাওয়ার মতো বেশ কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়, যেটি পরে স্বীকারও করে কর্তৃপক্ষ। যার প্রেক্ষিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সব টিকা বাজার থেকে প্রত্যাহার করেছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের মোট টিকার মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ বুস্টার ডোজসহ ৫ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার ৭৬৮ জন মানুষ এই টিকা গ্রহণ করেছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের অনেকের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও উদ্বেগ এবং নানা ধরনের শঙ্কা কাজ করছে।
এ ছাড়া কোনো ধরনের মানুষ পার্শ্ববর্তী প্রতিক্রিয়া পাশাপাশি কী উপসর্গ থাকতে পারে এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। খোদ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনও দেশে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা গ্রহণ করেছে তাদের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না তা খুঁজে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা নেওয়ার কারণে সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাবের সুযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি টিকা নিয়ে নতুন করে গবেষণা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।এ প্রসঙ্গে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার টিকা নেওয়ার পর থেকেই মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছে-বিষয়গুলো আমরাও শুনছি এবং আমাদের চিকিৎসক ও গবেষকরাও বলছেন, টিকা নেওয়ার পর থেকেই অনেকের থ্রম্বোসাইটপেনিয়া অথবা প্লাটিলেটের ঘাটতি দেখা গেছে। অনেক রোগীর রক্তে প্লাটিলেটের দ্রুত কমতে থাকছে। ফলে রোগী দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে। এখন যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের তো এ ধরনের সমস্যা কমন। তবে বাংলাদেশে যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো স্টাডি হয়নি। তাই নতুন করে গবেষণা করতে হবে। আসলে কী হয়েছে?
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ঠেকাতে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উদ্ভাবিত ‘ভেক্টর ভাইরাস’ অ্যাডেনোর প্রয়োগের মাধ্যমে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি করা হয়েছে। এ টিকা কিন্তু অনেক ইফেক্টিভ। কিন্তু এখন অনেকেই সন্দেহ করছে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্যই নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। আমরা বুঝতেছি একটা কিছু হয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে করোনায় শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়নি, অন্য ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়েছে। শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকার ঘাড়ে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাই যারা শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়েছে অন্য কোনো টিকা দেয়নি তাদের কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং এই টিকা নেওয়ার জন্যই হয়েছে কি না? সে জন্য আমাদের রিসার্স করতে হবে।
তিনি বলেন, মানুষের এই নিয়ে শঙ্কা করার কিছু নেই। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই দেখা যাচ্ছে, প্লাটিলেট অনেক কম। তখন অনেকেই প্রশ্ন করে এত কম কেন? হয়তো টিকা নেওয়ার কারণে কম পাওয়া যেতে পারে তাই বলে কেউ মারা যাচ্ছে কিংবা মারা যাবে এমন কোনো বিষয় নয়। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ চিন্তাই একটা বড় অসুখ।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নয় করোনার আরও যেসব টিকা দেওয়া হয়েছে সব টিকারই কম-বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। অনেক রোগীও পাওয়া গেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় ভুগছেন। সুতরাং বলা যায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সব টিকাতেই রয়েছে। তাই এই টিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর কিংবা খুব বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে তার কোনো ধারণা আমাদের নেই এবং তা প্রাণঘাতী হয়েছে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এখন যেহেতু নতুন গবেষণায় টিকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে এবং আমরা জেনেছি কিছু মানুষও মারা গেছে তাই কতটুকু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে তার জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসটি যখন গুরুতর আকারে দেখা দেওয়ার পর থেকেই ওমিক্রনসহ নানা সাব-ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন করোনাভাইরাস তার চরিত্র বদল করে জিনগত কিছু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়েছে এবং অভিন্ন মিউটেশন হয়েছে। এ কিছু বিবেচনা করে নতুন করে করোনার টিকা উদ্ভাবন করতে হবে। তাই ভবিষ্যতে যে করোনা, সার্স-কোভ-২ এবং সর্দি-কাঁশিসহ যে ভ্যারিয়েন্টিই আসুক না কেন এ জন্য এখন সার্বজনীন টিকা দেওয়া যায় কি না তা চিন্তা করতে হবে।
এই টিকা নেওয়ার ফলে অনেকেই উদ্বেগের মধ্যে তাদের ব্যাপারে কি পরামর্শ এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা নিয়েছেন তাদের উদ্বেগ হওয়ার কিছু নেই। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিয়ে এই টিকা দেওয়া হয়েছে। আর যারা টিকা প্রস্তুত করেন এবং বিশ্বে যারা গবেষণা করেন তাদের টিকা কতটুকু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা প্রকাশ করা উচিত। আমাদের দেশের গবেষকদেরও গবেষণা করা প্রয়োজন।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোনো প্রমাণ পেলে ওইসব টিকা দেওয়া হবে না। তবে যতক্ষণ সে রকম কোনো প্রমাণ না পাব, ততক্ষণ আমরা এই টিকা উঠিয়ে নেব না।
তিনি বলেন, আমি ডিজি হেলথকে নির্দেশ দিয়েছি। যাদের এই টিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর সার্ভে করে আমাকে প্রতিবেদন দেবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রমাণ না পাব, ততক্ষণ আমরা এই টিকা উঠিয়ে নেব না।
দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধে পরের বছরে ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে কোভিড টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া শুরু হয়। তার পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে কোভিড টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া শুরু হয়। এরপর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সময়ে ৫-১১ বছর বয়সি শিশুদেরও করোনার টিকা দেওয়া হয়। শুরুতে সবাইকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই দেওয়া হয়। পরে চীন থেকে সিনোফার্মের টিকা কেনে সরকার। কোভ্যাক্স থেকে মর্ডানার টিকাও আসে। চতুর্থ ডোজে বয়স্কদের দেওয়া হয় ফাইজারের টিকা। মূলত চারটি উৎস থেকে দেশে ছয় ধরনের টিকা এসেছে। এসব টিকার মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাকের টিকা পেয়েছে দেশের মানুষ। আর এসব টিকার মধ্যে বড় অংশই নিজস্ব অর্থায়নে কেনা। কিছু টিকা উপহার হিসেবে পাওয়া। একটি অংশ অনুদান হিসেবে কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া। বাকি আরেকটি অংশ কোভ্যাক্সের মধ্যস্থতায় ভর্তুকি মূল্যে কেনা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে ১৫ কোটি ৯ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ জন মানুষ টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। ১৪ কোটি ২২ লাখ ৮৬২ জন মানুষ দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে। সেই সঙ্গে ৬ কোটি ৮৬ লাখ ৫ হাজার ৬৭৫ জন তৃতীয় ডোজ এবং ৫১ লাখ ৪৩ হাজার ৬২৯ জন চতুর্থ ডোজের টিকা নিয়েছেন।