প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে বেনাপোল ট্রেনে আগুনের ভয়ঙ্কর বর্ণনা

‘মুহূর্তে আগুন বেড়ে যাওয়ায় দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিল’

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক 

দুর্বৃত্তদের দেওয়া  আগুনে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) রাত ৯টার দিকে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন যাত্রী দগ্ধ হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে বেনাপোল ট্রেনে আগুনের ভয়ানক বর্ণনা  দিয়েছেন।  তাদের কেউ বলছেন, ট্রেনে আগুন লাগার সময় জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। হাত বাড়িয়েছিলেন সাহায্যের জন্য, বের হতে পারেননি। তার অর্ধেক শরীর ট্রেনের জানালার বাইরের, অর্ধেকটা ভেতরে। শত শত মানুষের চোখের সামনে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হলেন যাত্রী।আবার অনেকের বর্ণনামতে, আগুনে বেশ কয়েকজন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না থাকায় নেভানো যায়নি আগুন। শুধু তাদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছে। এমন কি আগুন লাগার প্রায় এক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস এসেছে বলে অভিযোগ তাদের।

এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে নেভাল আর্কিটেকচারে সদ্য পাশ করা মো. সামিউন নূর ইসলাম চুয়াডাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।

শুক্রবার ঢাকায় ফেরার জন্য দর্শনা স্টেশন থেকে বিকেল সাড়ে ৩টায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠেছিলেন তিনি। সেই ট্রেনটি ঢাকায় ঢুকে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে গোপীবাগ এলাকায় সেটিতে আগুন লেগে যায়।

ট্রেনের কামরাগুলোতে আগুন লেগেছিল, সেগুলোর একটিতে ছিলেন সামিউন। তিনি রাতে  বলেন, কামরার পেছনের দরজার কাছে বসে ছিলেন। আগুন ধরেছিল সামনের দিকে। রাত ৯টা ৪ মিনিটের দিকে কামরায় আগুন ধরলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত তিনি ল্যাপটপের ব্যাগটা নিয়ে দরজায় চলে যান। ট্রেন তখনও চলছিল।

তিনি বলেন, ‘এ সময় সবাই পরের বগিতে যাবার চেষ্টা করছিল। কারণ মুহূর্তে আগুন বেড়ে যাওয়ায় সবার নিশ্বাস নিতেও অসুবিধা হচ্ছিল। কোনো গ্যাস বা কিছু দিয়েছিল, যার জন্য নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’

এ সময় দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে মুখ রেখে শ্বাস নিচ্ছিলেন জানিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে সামিউন লিখেছেন, ‘অনেক চিৎকার করছিলাম, আগুন লেগেছে, থামান বলে। আমার জ্ঞান সম্ভবত সম্পূর্ণ ছিল না। কেউ চেইনও টান দেয়নি। পরে দুইজন লাফ দিল, আমি দেইনি। কারণ ভেবেছি, লাফ দিলেও মারা যাব। এদিকে আগুন আমার অব্দি চলে এসেছিল। ট্রেন ২ থেকে ৩ মিনিট পর থামলে আমি আর দাঁড়াইনি।

ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়ে সামিউন লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ বাঁচাইছে। আমার একটা ব্যাগ বাদে সব ঠিক আছে। তবে নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। অনেক সময় ধরে কালো কালো কাশি উঠছিল।’ রাতে বাসায় ফেরার সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন সামিউন।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নাফিস আলম (২২)। তিনি জানান, রাজধানীর গোপীবাগ ক্রসিংয়ে চলন্ত ট্রেনে আগুন দেখে জানালা খুলে লাফিয়ে পড়েন তিনি। পরে একজন মোটরসাইকেল চালকের সহায়তায় কাজীপাড়ায় বন্ধুদের কাছে যান। সেখানে তারা তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসেন।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একথা জানান নাফিসের বন্ধু আব্দুল আলীম। নাফিস ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে এবার ডিপ্লোমা  ইঞ্জিনিয়ারিং (কম্পিউটার সায়েন্স) পাস করেছেন। ঢাকায় চাকরিতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভাঙা থেকে ট্রেনে আসছিলেন তিনি। ট্রেনে আগুনে আহত অবস্থায় লাফ দেন নাফিস। এতে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পান।

তার বন্ধু আলিম জানান, তার শরীর পুরো কালো হয়েছিল। গলা, কানের পাশে জ্বলে গেছে। আমরা বাসায় তাকে পরিষ্কার করে এখানে নিয়ে আসি।

তার বন্ধুরা জানান, ১ জানুয়ারি একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর ভাঙ্গার বাঁকুড়া গ্রামে। বর্তমান মিরপুর কাজীপাড়ায় তারা পাঁচ বন্ধু মিলে একটি মেসে থাকেন। বৃহস্পতিবার নিাফিজ গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। শুক্রবার ভাঙ্গা থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় আসছিলেন।

নাফিসকে নিয়ে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন তিন জন। অন্য দুই জন হলেন ডা. কৌশিক বিশ্বাস (৩৫) ও আসিফ মো. খান (৩০)। আসিফের স্ত্রী ট্রেনে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন  আগুনে দগ্ধ  হওয়া আসিফ  ও  তার পরিবার বলছে, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে থাকা আসিফের স্ত্রী নাতাসা জেসমিন (২৫) আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।

শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাতে আসিফকে উদ্ধার করে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়।

আসিফ তার স্ত্রীকে নিয়ে ভাঙ্গা উপজেলায় ঘুরতে যায় তবে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় তাদের স্থানীয় বাড়ি। আসিফ ভাঙ্গা থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে আগুনের ঘটনায় তার স্ত্রী মারা যায়।

এবং সে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।  তবে তার অবস্থা গুরুতর নয়।

বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধ আসিফের বাবা সিদ্দিকুর খান তার পুত্রবধূর মৃত্যুর খবরটি জানান।

ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) বাচ্চু মিয়া জানান, আসিফের ৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।এখন পর্যন্ত দগ্ধ হয়ে তিনজন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসরা।

শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতালটির প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তিনজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। দু’জনই আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন। একজনের আট শতাংশ বার্ন হয়েছে। তার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।

্ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, তারা ঝুঁকিমুক্ত নন। আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। ঘটনাস্থল থেকে আরও আহত রোগী আসতে পারে বলে ধারণা করছি। আমরা প্রস্তুত আছি চিকিৎসার জন্য। এই ধরনের ঘটনা কখনই কাম্য না।।

আগুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ। সেই ভয়াবহ ও নির্মম   বর্ণনা দেন।

তিনি জানান, বেনাপোল ট্রেনে আগুনের  সুন্দরবন ঘুরে বাড়িতে গিয়েছিলাম। কারণ  ভোটের পরে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে আগে ভাগে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। পাশাপাশি নতুন টিউশনি পেয়েছি। আবার চলতি মাসের শেষের দিকে একটি চাকরির পরীক্ষাও আছে। তাই আবারও বাড়ি ফিরতে হবে। সবকিছু মাথায় রেখেই আজ শুক্রবার আমি চুয়াডাঙ্গা থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই।

তিনি জানান, ট্রেনে ওঠার পর থেকে রাজু ঘুমায়নি। কারণ, যদি কোথাও লাইন কাটা থাকে বা দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে যেন দ্রুত নেমে পড়তে পারি, সেই আশঙ্কায় সারাক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছি। তিনি জানান, কমলাপুর পৌঁছানোর ঠিক আগেই রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে আগুন লেগে যায়। সৌভাগ্যক্রমে আমি  বেঁচে ক্যাম্পাসে ফিরেছি।

রাজু আহমেদ বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা থেকে বিকেল চারটায় ট্রেনে উঠি। কমলাপুর রেলস্টেশনে রাত নয়টায় নামার কথা ছিল। ঢাকার কাছাকাছি আসার সময় ভেবেছিলাম বাসার পাশে গেন্ডারিয়া স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে নেমে যাব। পরে ট্রেন না দাঁড়ানোই, ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই টয়লেটে যাই। গিয়ে দেখি আমাদের বগির টয়লেট গেটের লক নষ্ট। পরে সামনের বগির টয়লেটে যাই।

রাজু আহমেদ আরও বলেন, ‘টয়লেটে গিয়ে বাইরে থেকে মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। ভেবেছিলাম হয়তো ট্রেন স্লো করেছে। মানুষ নামছে। দ্রুত টয়লেট থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে শুনি ট্রেনে আগুন লেগেছে। টয়লেট থেকে বের হতে পারছিলাম না মানুষের ভিড়ে। সামনে এক নারী তাঁর তিনটি বড় ব্যাগ নিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন। তাঁকে ঠেলে নেমে পড়ি। পরে উনিও নেমে পড়লে সবাই নামার চেষ্টা করে।’

ট্রেনটি আগুন লাগার পর যে স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল, সে স্থানে ট্রেন থেকে নামা অনেক কষ্টের ছিল বলে জানান রাজু আহমেদ। বলেন, কারণ এখানে তো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। তাই সবার নামতে কষ্ট হচ্ছিল।

‘৩০ সেকেন্ডের কম সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে’ উল্লেখ করে রাজু বলেন, ‘নেমে চোখের সামনেই দেখি চ বগিতে আগুন লেগেছে। সেখানে এলাকার এক ছোট ভাই ছিল, দুজনে একসঙ্গে নামারও কথা ছিল। কিন্তু আগুনের ভয়াবতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল,  যে যেভাবেই পারছে সেই ভাবে নেমে পড়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় আরেক এলাকাবাসী মিজবাহুর আলম  বলেন, ট্রেনটি চলতি অবস্থাতেই আগুন লেগে এখানে আসে। ট্রেনটি দাঁড়ানোর সাথে সাথেই স্থানীয় লোকজন ছুটে আসে। পার্শ্ববর্তী বাড়িগুলো থেকে যে যেভাবে পেরেছে পানি দিয়ে সহযোগিতা করেছে।

তিনি আরও বলেন, ভিতর একজন লোক পুড়ে মরে আছে দেখছেন, তিনি অনেক রিকোয়েস্ট করছেন আমারে বাঁচাও, আমারে বাঁচাও। উনার বউ-বাচ্চাও ট্রেনে ছিলো। কিন্তু আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক হোসেন বলেন, আমরা এলাকাবাসী, যখন আগুন লেগেছে দৌড়ে এসেছি। যার কাছে যতটুকু পানি ছিল আমরা সেভাবে চেষ্টা করেছি, কিছুই করতে পারিনি।

তিনি বলেন, অনেক মানুষ আমার চোখের সামনে মারা গেছে। এলাকাবাসী সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু তাদেরকে উদ্ধার করতে পারিনি। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নেই।

এদিকে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত  একটি ভিডিওতে দেখা গেছে , ট্রেনের একটি জ্বলন্ত বগির জানালায় একজন নিথর হয়ে পড়ে আছেন।

শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাতে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে গোপীবাগ এলাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে মিডিয়া কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, রাত ৯টা পাঁচ মিনিটে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদের পর ধাপে ধাপে পাঁচটি ইউনিট পাঠানো হয়।

পরে ফায়ার সার্ভিসের এক বার্তায় বলা হয়, দুর্বৃত্তরা বেনাপোল এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ ও একটি পাওয়ার কারে আগুন দিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, বেনাপোল এক্সপ্রেসের পাঁচটি বগি একেবারে পুড়ে গেছে।এসি কারের জানালা বন্ধ থাকায় হতাহতের পরিমাণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

এদিকে, ট্রেনে আগুনের ঘটনায় ৭ সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com