রাজশাহী প্রতিনিধি।।
একজন রোগীর কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হলে প্রথমেই চিন্তায় পড়েন চিকিৎসকের ফি বা ভিজিট নিয়ে। কারণ শহর থেকে শুরু উপজেলা পর্যায়ে একটু ভালমানের হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাঁরা বসেন তাদের ফি ১০০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফি বেশি হওয়ায় বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসকরা নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। অর্থাৎ দেশজুড়ে ডাক্তারদের ফি নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য ও অরাজকতা চলছে। তবে দেশে কিছু কিছু ডাক্তারদের ভিজিট দৌরাত্ম্য থাকলেও ব্যতিক্রমও আছে। যারা অল্প ভিজিটে রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন। আবার অনেক সময় বিনা পয়সায় সেবা দেন কেউ কেউ। আর এমনই দৃষ্টান্ত তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন রাজশাহীর তিন বোন। তারা তিনজনই ডাক্তার। রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেন তবে ভিজিট হিসেবে নেন মাত্র এক টাকা। তারা হলেন সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল, আয়েশা সিদ্দিকা, ফারজানা মোজাম্মেল।
২০২৩ সালে এই ‘এক টাকায় চিকিৎসা’ সেবার সূচনা করেন ডা. সুমাইয়া। এরপর তার দুই বোনও একই পথে হাঁটেন। তাঁদের দাবি, এ উদ্যোগ তাঁদের বাবা মীর মোজাম্মেল আলীর অনুপ্রেরণায় শুরু।
ডা. সুমাইয়া ২০২০ সালে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর সাহেববাজার এলাকায় বাসার নিচে চেম্বারে এই সেবা প্রদান করছেন। আয়েশা সিদ্দিকা জেনারেল ফিজিশিয়ান, আর ফারজানা মোজাম্মেল একজন ডেন্টিস্ট। তাঁরা পর্যায়ক্রমে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন।
তিন বোনের বাবার ইচ্ছায় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার বদলে প্রতীকী মূল্য এক টাকা রাখা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁদের উদ্যোগ ভাইরাল হওয়ার পর রোগীদের ভিড় বাড়তে থাকে।
তাঁদের সেবায় উপকৃত হয়েছেন অসংখ্য দুস্থ ও অসহায় মানুষ। যেমন, শামীমা খাতুন নামে এক রোগী জানান, সাত মাস ধরে চিকিৎসা নিয়ে তিনি উপকৃত হয়েছেন। দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসা কলেজ ছাত্র রফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর সমস্যাগুলো অনেকটাই কমে গেছে।
এই সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় তহবিল সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে তা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে আরও মানুষকে সহায়তার জন্য কাজ করতে চান এই তিন ডাক্তার বোন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে মাত্র এক টাকা ভিজিট নিয়ে রোগী দেখা শুরু করেন এমবিবিএস চিকিৎসক সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল। চিকিৎসক মেয়ের জন্য শিক্ষক বাবা মীর মোজাম্মেল আলী প্রচারপত্র বানিয়ে ছিলেন। এই প্রচারপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা মুহূর্তে ভাইরাল হয়। এরপর অসহায় দুস্থ রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসতে শুরু করেন সুমাইয়ার চেম্বারে।
রাজশাহীর চিকিৎসক সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল বলেন, এক টাকায় রোগী দেখার উদ্যোগটা বাবার। তার ইচ্ছেতেই রোগী দেখা শুরু করি। এটা এতোটা ভাইরাল হবে ভাবিনি। আমাদের তিন বোনকে এভাবেই গড়ে তুলেছেন বাবা। আমরা তিন বোনই ডাক্তার। আমরা তিন বোন একেক দিন একেক বোন সময় দিয়ে থাকি। আর আমার বাবা একদম বিনামূল্যে রোগী দেখতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি একটা প্রতীকি মূল্য রাখতে চেয়েছি।
ডা. সুমাইয়া বলেন, আমি ২০২০ সালে ইসলাম ব্যাংক মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। ২০২৩ সালে এই উদ্যোগটা শুরু করি। কিন্তু আমি রোগী দেখতে পারবো কি না? এমন প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন। যা খুবই দুঃখজনক। অথচ আমি এখানে প্রাইমারি ট্রিটমেন্টটা দেই। জটিল কোন সমস্যা হলে সে অনুযায়ী ডাক্তারদের কাছে রেফার্ড করি। আমি ইসলামি ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন নিয়মিতই চেম্বার করছি। সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা কোন কিছুর বিনিময়ে কেনা সম্ভব না।
বিনামূল্যে রোগী না দেখার কারণ হিসেবে সুমাইয়া বলেন, তার উদ্যোগে কয়েকজন মিলে করোনার সময় থেকে ‘দ্য ফাইভ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করছেন। সংগঠনের উদ্যোক্তা সদস্যদের নিজেদের আর্থিক সহায়তায় মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছে এ সংগঠন। তবে অনুদান না পাওয়ায় সবটাই তাদের নিজেদের ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।
তিন চিকিৎসকের স্কুল শিক্ষক বাবা মীর মোজাম্মেল আলী বলেন, আমার তিনটা মেয়ে। মেয়েদেরকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পেরেছি। তারা আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে। আমি মানুষের জন্য কাজ করি। আমার মেয়েরাও কর্মজীবনে যাই করুক না কেন, তারা যেন অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে।