নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যা তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও শারীরিক সুস্থতায় মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে। গবেষণায় ৫০০ শিশুর নমুনার ৯৮ শতাংশতে সীসা পাওয়া গেছে, যার মধ্যম মাত্রা ৬৭ মাইক্রোগ্রাম/লিটার। অথচ সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মানদণ্ড অনুসারে উদ্বেগজনক মাত্রাই ৩৫ মাইক্রোগ্রাম/লিটার। আর ঢাকার আশপাশে সীসা-নির্ভর কারখানার এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সীসার মাত্রা অন্যদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি।
বুধবার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণা ফলাফলে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সীসা দূষণ প্রতিরোধ অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক বিশেষ আলোচনা সভায় সীসা দূষণের ব্যাপকতা ও এর ভয়াবহতা তুলে ধরা এবং এর থেকে মুক্তির উপায়গুলো আলোচনা করা।
সভায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিষাক্ত ধাতু শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও শেখার দক্ষতাকে কমিয়ে দেয় এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এ অবস্থায় সীসা দূষণের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে দেশের লাখ লাখ শিশু বুদ্ধিবিকাশে স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়বে বলে সতর্ক করা হয়। সেইসঙ্গে শিশুদের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ খুবই জরুরি বলেও মনে করছেন তারা।
সভা থেকে বলা হয়, সিসা একটি বিষাক্ত ভারী ধাতু, যা নীরবে লাখ লাখ মানুষের, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে। রক্তের মধ্যে সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) শিশুদের রক্তে প্রতি লিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসার উপস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মনে করে।
অনুষ্ঠানে ২০২২-২৪ সালের এক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরেন আইসিডিডিআরবির অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট জেসমিন সুলতানা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পরিচালিত গবেষণায় ২ থেকে ৪ বছর বয়সী ৫০০ শিশুর রক্ত পরীক্ষা করে প্রতিটি শিশুর রক্তেই রয়েছে সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
আইসিডিডিআর,বি-র সায়েন্টিস্ট ডা. জেসমিন সুলতানা জানান, প্রতিটি শিশুর রক্তেই সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে (মধ্যমমাত্রা: ৬৭ মাইক্রোগ্রাম/লিটার), এবং ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিডিসির উদ্বেগজনক মাত্রা ৩৫ মাইক্রোগ্রাম/লিটারের চেয়ে বেশি সিসা ছিল। এই গবেষণায় চিহ্নিত সিসা-নির্ভর শিল্প স্থাপনার ১ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা ছিল ৫ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। অন্যান্য উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘরের ভেতরে ধূমপান, দূষিত ধূলিকণা, সিসাযুক্ত প্রসাধনী সামগ্রী ও রান্নার পাত্র।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিডিডিআরবির হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন-এর সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারাহ স্যালওয়ে।
তিনি বলেন, সিসা দূষণ বাংলাদেশের একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। বিশেষ করে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পের আশপাশের শিশুরা এর সবচেয়ে বড় শিকার।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে সিসা দূষণে আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু রক্তে উচ্চ মাত্রার সীসা নিয়ে জীবনধারণ করছে।
সভায় উপস্থাপিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ঢাকার বস্তি এলাকায় ২ বছরের কম বয়সী ৮৭ শতাংশ শিশুর রক্তে প্রতি লিটারে সীসার মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি ছিল, যা তাদের শারীরিক বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতার একটি প্রধান কারণ।
সভায় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং আইসিডিডিআরবির সাবেক পরিচালক, প্রফেসর স্টিভ লুবি বলেন, সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এর ফলে বুদ্ধিমত্তা ও শেখার ক্ষমতা কমে যায়, যা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে।
তিনি আরও বলেন, আমরা নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বাতাস নিই, যে খাবার খাই, দূষিত মাটি বা ধূলিকণা স্পর্শ করি এবং এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের প্লাসেন্টা থেকেও সিসা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এ বহুবিধ উপায়ে সিসা প্রবেশ করে বলে, এর থেকে বাঁচতে হলে এর মূল উৎসগুলো বন্ধ করা জরুরি।
আইসিডিডিআরবির প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর ডা. মো. মাহবুবুর রহমান গত ১০ বছরের সিসা-সম্পর্কিত গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সিসা দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সিসা ও ব্যাটারি-সম্পর্কিত শিল্প-কারখানা, সিসাযুক্ত রঙ এবং প্রসাধনী ও রান্নার পাত্রের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
তবে আশার কথা হলো, হলুদে ভেজাল (লেড ক্রোমেট দিয়ে পালিশ করা) প্রতিরোধে বেশ সফলতা এসেছে। স্ট্যানফোর্ড ও আইসিডিডিআর,বি-এর একটি দল গর্ভবতী নারীদের রক্তে সিসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে হলুদকে চিহ্নিত করার পর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ, ২০১৯ সালে যেখানে ৪৭ শতাংশ হলুদের নমুনায় সিসা পাওয়া যেতো, তা কমে ২০২১ সালে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে।
এ আলোচনা সভা থেকে সিসা-নির্ভর শিল্প স্থাপনা, যেমন সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি বানানো বা রিসাইক্লিং করার কারখানা বা স্থাপনা, অথবা যেসব কারখানা বা স্থাপনায় সিসা গলানো বা পোড়ানো হয়, এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কারণ, এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরিয়ে নিলে বা দূষণ কমানোর ব্যবস্থা নিলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিশুদের সিসা দূষণ থেকে বাঁচানো সম্ভব।
সমাপনী বক্তব্যে আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, সিসা বিষক্রিয়া নীরবে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেড়ে নিচ্ছে। এটি তাদের মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশ ব্যাহত করে ও দেহে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি করে। তাই আমাদের এখনই এ সিসা নিঃসরণকারী ক্ষতিকর উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে, যাতে প্রতিটি শিশু সুস্থ ও বুদ্ধিমান হয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং আমাদের দেশের উৎকর্ষ সাধনে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
এ আলোচনা সভায় আইসিডিডিআরবি এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ও সাংবাদিকরা অংশ নেন। বাংলাদেশের শিশুদের জন্য একটি সুস্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়।