ম্যালেরিয়ার পরিস্থিতি পাল্টায়নি, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয়

মোট আক্রান্তের তিন জেলায় রোগী ৯২ শতাংশ

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।। 

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া দিবস পালন করা হয়। দেশে মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হল ম্যালেরিয়া। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ৬৪১ জন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এই সময়ে এক জনের মৃত্য হয়েছে। আর আগের বছর ২০২৪ সালে মোট আক্রান্ত হন ১৩ হাজার ৯৯ জন এবং মৃত্যুবরণ করে ৬ জন। আর ২০২৩ সালে দেশে মোট রোগী ছিল ১৬ হাজার ৫৬৭ জন, বিপরীতে মারা যান ছয় জন। তার আগের বছর  ২০২২ সালে আবার বেড়ে যায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। সে বছর ১৮ হাজার ১৯৫ জন আক্রান্তের বিপরীতে মারা যান ১৪ জন। স্বাস্থ্য অধিফতরের ম্যালেরিয়া আক্রান্তের পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্ত রোগীর ৯২ শতাংশই তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দা। যদিও গত তিন বছরের দেশে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু  নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ম্যালেরিয়া পুরোপুরিভাবে নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আর এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ম্যালেরিয়া নির্মূলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি। এছাড়াও সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলাকে ম্যালেরিয়া প্রবণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত তিন পার্বত্য জেলাতেই মোট আক্রান্তের  ৯২ শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে। এই এলাকায় ব্যবস্থাপনাসহ নানা দুর্বলতা এবং সময়োপযোগী উদ্যোগের অভাব, প্রকৃতি, মশা ও মানুষের আচরণে পরিবর্তন, ঘন বন, গহীন জঙ্গল এবং  দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে গতানুগতিক পদ্ধতি ম্যালেরিয়া নির্মূলে  কোনও কাজে আসছে না। তাই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারের ‘জিরো ম্যালেরিয়া’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে একেবারে নির্র্মূল করা না গেলেও মাঠ পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন।

 

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। সংশ্লিষ্ট বলছেন, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার বদ্ধপরিকর এবং নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই ম্যালেরিয়া নির্মূল করার ব্যাপারে আশাবাদী।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ম্যালেরিয়া পুরোপুরিভাবে নির্মূলে তিন পার্বত্য জেলাসহ পাশ্ববর্তী/ সীমান্তবর্তী দেশসমূহের সাথে সমন্বয় সাধন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। আন্তঃসীমান্ত চলাচল/ পারাপারকারীদের যথাসম্ভব চিহ্নিত করে তাদের ম্যালেরিয়া বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। তবে পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় এই প্রক্রিয়ায় ম্যালেরিয়া নির্মূলে কিছু সংকট রয়েছে বলেও জানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ শুক্রবার বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আমরাই করবো ম্যালেরিয়া নির্মূল: নব উদ্যমে, নব বিনিয়োগে ও নব চিন্তায়’।

সরকারের ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, দেশে  ২০১৪ সালে ম্যালেরিয়ায় সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে। ম্যালেরিয়ায় ওই বছর মোট আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৪৮০জন। আর মৃত্যু হয়েছিল ৪৫ জনের। ওই আক্রান্তদের মধ্যে সবোর্চ্চ ৫৯ শতাংশ ছিল বান্দরবান জেলার, এরপর রাঙ্গামাটিতে ২৯ শতাংশ, কক্সবাজার এলাকায় ৭.৩ শতাংশ, খাগড়াছড়ি  জেলায়  ৪ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য জেলায় ০.৬ শতাংশ।পরের বছর ২০১৫ সালে আক্রান্ত হন ৩৯ হাজার ৭১৯ জন, মারা যান নয় জন। ২০১৬ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কমে ২৭ হাজারে নামলেও মৃত্যু আবার বেড়ে যায়। সে বছর মারা যান ১৭ জন। এরপর ধারবাহিকভাবে এটি কমে ২০২০ সালে হয়  ছয় হাজার  ১৩০ জন, তখন মৃত্যু হয়  ৯ জনের। বর্তমানে দেশের ১৩টি জেলার ৭২টি থানায় ম্যালেরিয়া রোগের উপস্থিতি রয়েছে।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরে পরিসংখ্যান বলছে, গত ১২ বছরে রোগী কমেছে ৮৫ শতাংশ এবং মৃত্যু কমেছে ৯৬ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর ৯২ শতাংশই তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দা। জেলাগুলো হলোÑ বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি।

এর মধ্যে বান্দরবান, রাঙ্গামাটিতে ৮৯ শতাংশ রোগী।  এটি গত ১০ দশ বছর ধরে একই হারে চলছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সর্বাধিক হওয়ায় জেলাগুলোকে উচ্চ ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলার ৭৭টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এখনো বেশি। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের আওতাধীন ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের ৮টি জেলায় মোট স্থানীয় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ জন। ৮টি জেলার মধ্যে ৬টি জেলায় (কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ এবং সিলেটে) স্থানীয় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা শূন্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রস বর্ডার তথা সীমান্ত অতিক্রম করে অনেকে ভারত ও মায়ানমারে চলাচল করছে। কখনো কখনো পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় অশান্ত হওয়ায় বিধিনিষেধ থাকে। পাহাড়ি আদিবাসীদের ভাষা বোঝা ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মীয় কুসংস্কার রয়েছে। পার্বত্য জেলাগুলো দুর্গম এলাকায় হওয়ায় বর্ষাকালে ওষুধ, পরীক্ষা-নীরিক্ষার নিয়মিত রেকর্ড সংরক্ষণ করা কঠিন হয়। সঠিক সময়ে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা যায় না। এসব কারণে অ্যানোফিলিস মশাবহিত রোগ ম্যালেরিয়া নির্মূল কঠিন হচ্ছে।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল শাখা স্বীকার করছে ম্যালেরিয়া নির্মূলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে চলাচল/পারাপারকারীর মধ্যে ইমপোর্টেড ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।

 

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ্যামল কুমার দাস বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে এবং চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। যাতে করে আক্রান্ত ও মৃত্যু বন্ধ করা যায়। এছাড়াও

 বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের প্রাদেশিক পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক চলমান রয়েছে। আন্তঃসীমান্ত চলাচল/পারাপারকারীদের যথাসম্ভব চিহ্নিত করে তাদের ম্যালেরিয়া বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (জুম চাষী, কাঠুরিয়া, কয়লা শ্রমিক, রোহিঙ্গা শরণার্থী ইত্যাদি) তথ্য সংগ্রহ করে কর্মসূচীর আওতায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সীমান্তে দুই পাশে সমন্বিত বাহক নিয়ন্ত্রণ এবং কীটতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ কার্যক্রমকে জোরদার করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

 

তিনি আরও জানান, জোরপূর্বক বাস্থচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে দীর্ঘস্থায়ী কীটনাশকযুক্ত মশারি ক্যাম্পে বিতরণ করা হয়েছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতেও ম্যালেরিয়ার বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ম্যালেরিয়া সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠনের (নিপসম) কীটতত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম সারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, অ্যানোফিলিস মশা আদ্রর্তা মিশ্রিত ছায়াযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকে। অর্থাৎ ঝোপ ঝাড় ও পাহাড়ি এলাকায় এদের প্রাচুর্যতা লক্ষনীয়। এরা মানুষ ও গবাদি পশুর রক্ত বেশী পছন্দ করে। পূর্নাঙ্গ মশা দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। এই মশা ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী প্লাজমোডিয়াম নামক প্রোটোকটিষ্ট জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। আশা করা যাচ্ছে, এই জেলাগুলিতে অচিরেই ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় এই প্রক্রিয়ায় ম্যালেরিয়া নির্মূলে কিছু সংকট রয়েছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. অধ্যাপক কবিরুল বাশার  বলেন,  দেশে মোট ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা দেখা যায়, এদের মধ্যে সাতটি প্রজাতি দেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। আবার তার মধ্যে বাংলাদেশে  চারটি প্রজাতিই ম্যালেরিয়ার প্রধান বাহক। আর ম্যালেরিয়া নির্মূলের একইপদ্ধতি অনেক বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে প্রকৃতি, মশা ও মানুষের আচরণে পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে মশা নির্মূল কিংবা রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা কোনটাই সম্ভব হচ্ছে না। ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে হলে প্রথমে গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি।

তিনি বলেন, দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এটি এখনও হুমকিস্বরূপ। এর অন্যতম কারণ, ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ম্যালেরিয়া এদেশে প্রবেশের ঝুঁকি রয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য করে তুলছে।আবার জলবায়ু পরিবর্তনও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবেও কাজ করছে। তাই  নির্ধারিত সময়ে ম্যালেরিয়া পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা নিয়ে কিছু সংশয় রয়েছে বলেও জানান তিনি।

 

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com