মাইলস্টোন  ট্র্যাজেডি: দগ্ধদের মধ্যে এখনো বার্ন ইউনিটে ৩২ রোগী, ২৭ জনই শিশু

স্কুলে কাউন্সেলিং: শিক্ষার্থীদের খারাপ স্মৃতি না ভেবে ভালো স্মৃতি ভাবার পরামর্শ

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ঢাকার উত্তরার মাইস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখনো ৩২ জন ভর্তি রয়েছে। এদের মধ্যে ২৭জনই শিশু। আর বয়স্ক পাঁচজন। তাদের মধ্যে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)  আছেন দুজন। তিনজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। সিভিয়ার রোগী সাতজন। এছাড়া  শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় একজনকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তার নাম ফারজানা ইয়াসমিন (৪৫)। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষিকা তিনি।
বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন।
পরিচালক বলেন, মঙ্গলবার আইসিইউতে ছিল ৩ জন। তবে তাদের মধ্যে একজনের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আজ তাকে এইচডিইউ’তে স্থানান্তর করা হয়েছে। এখন মোট ৩২ জন রোগী ভর্তি আছে। যাদের মধ্যে ৩ জন ক্রিটিকাল ক্যাটাগরিতে আর তাদের চাইতে কম গুরুতর ৭ জন রয়েছে সিবিয়ার ক্যাটাগরিতে। বাকিরা অন্যান্য ওয়ার্ড ও কেবিনে ভর্তি রয়েছে। গত ৩ দিনে নতুন করে কোন মৃত্যু নেই।
তিনি বলেন, ৩২ জনের ১৪ জন শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। বাকিরা স্ট্যাবল রয়েছে। ঘটনার পর থেকে  বুধবার পর্যন্ত এসকল রোগীকে একেকজনকে একাধিকবারসহ সবমিলিয়ে ১৫৮টি ছোট-বড় অপারেশন করা হয়েছে।রোগীদেরকে বিদেশি চিকিৎসকরাও দেখছেন এবং পর্যবেক্ষণ করছেন।
পরিচালক বলেন, বুধবারের পর থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনুষ্ঠানিক ব্রিফ আর হবে না। প্রেস রিলিজের মাধ্যে প্রতিদিনের আপডেট জানিয়ে দেয়া হবে।
অধ্যাপক ডা. নাছির উদ্দীন বলেন, মাইলস্টোনের রোগীদেরকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি রাখা হচ্ছে না, চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
ডা. নাছির উদ্দীন বলেন, অনেক রোগীই মানসিক ট্রমায় আছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়েও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করা হচ্ছে।
গত ২১ জুলাই এই ক্যাম্পাসে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে। বুধবার বিকালে  স্বাস্থ্য অধিফতর থেকে পাঠানো তথ্য বলছে, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৪৪ জন। এর মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩৩ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ১১ জন এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একজন ভর্তি রয়েছেন।
এদিকে,যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাউন্সেলিং অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প বসিয়ে দেওয়া হয় চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপত্র। কাউন্সেলিং আর চিকিৎসাসেবা নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাসে যান অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবরা।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদেরপাশাপাশি কিছু উৎসুক লোকজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভেতরে যেতে দেখা গেছে। উৎসুক লোকজন মূলত বিমান বিধ্বস্তের জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের কাছাকাছি এলাকার শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসটিতে আসেন। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের বুধবার ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মোমিনুল ইসলামের সঙ্গে। সে কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী।
ক্যাম্পাসে আসার কারণ জানতে চাইলে মোমিনুল বলে, আজকে শিক্ষকেরা আমাদের ডেকে ছিলেন। জানতে চেয়েছেন, বিমান বিধ্বস্তের পর আমাদের কারও কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? বিশেষভাবে মানসিক কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? হয়ে থাকলে কাউন্সেলিং নিতে বলেছেন।
মোমিনুল কাউন্সেলিং নিয়েছে জানিয়ে বলে, বিমান বিধ্বস্তের সময় আমি শ্রেণিকক্ষে ছিলাম। বিস্ফোরণের সময় বাইরে বেরিয়ে চোখের সামনে অনেককে আগুনে পুড়ে যেতে দেখেছি। যারা আমাদের জুনিয়র, ছোট ভাইবোন। তখন তাদের বাঁচাতে আমি পারিনি। তাদের আগুনে পুড়তে দেখা, তাদের জন্য কিছু করতে না পারায় আমার এখনো খারাপ লাগে, কষ্ট পাই।

১৫ মিনিটের মতো কাউন্সেলিং পেয়েছে বলে জানায় মোমিনুল। কাউন্সেলিংয়ে পাওয়া পরামর্শ সম্পর্কে সে বলেন, আমাকে বলেছেন, যেসব কাজ করতে ভালো লাগে, আমি যেন সেগুলো আরও বেশি বেশি করি।
আরও বলেছে, খারাপ স্মৃতি না ভেবে ভালো ভালো স্মৃতিগুলো নিয়ে যেন ভাবি। আর আমার বয়সে আমি সেদিন যেটুকু করতে পেরেছি, সেটা যথেষ্ট বলে জানিয়েছে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় তুরাগের নলভোগের বাসিন্দা রবিউল হাসানের সঙ্গে। তিনি মোটরসাইকেলে করে মেয়ে হাফসা ইয়াসমিন ও চার বছর বয়সী ছেলে ফারদিনকে সঙ্গে করে ক্যাম্পাসে আসেন। তার মেয়ে হাফসা মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
রবিউল হাসান বলেন, মেয়ের শ্রেণিশিক্ষক ডেকেছিলেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জানার চেষ্টা করবেন। তবে তার মেয়ে ঘটনার আগের দিন ও ঘটনার দিন অসুস্থতার জন্য স্কুলে আসেনি। আর ছেলেকে এমনিতেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
কাকি ও দাদির সঙ্গে ব্যাগপত্র নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসছিল কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্রোত সরকার। বেলা ১১টার দিকে প্রধান ফটকের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। সে বলে, দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির টাকা জমা দিয়েছি। কলেজ ছুটি থাকায় এখন গ্রামের বাড়ি যাবো।
স্রোত সরকার জানায়, একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা শেষে সে নারায়ণগঞ্জে কাকার বাসায় চলে গিয়েছিল। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা শুনে সেদিন বিকেলে কলেজে আসে। রাতে কলেজের হোস্টেলে ছিল। রাতে কলেজে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স আসায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছিল। পর সকালে তাদের চলে যেতে বলে কর্তৃপক্ষ। তাই আবার কাকার বাসায় চলে গিয়েছিল। আজ ভর্তির টাকা জমা দিয়ে দাদি ও কাকিকে সঙ্গে গ্রামের বাড়ি যাবেন।
গত সোমবার মাইলস্টোনের এই ক্যাম্পাসে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। সেখানে দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবা, পরামর্শ ও ওষুধপত্র দেওয়া হচ্ছে। আর মানসিক আঘাতে (ট্রমা) ভুগছেন, এমন ব্যক্তিদের প্রয়োজন হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com