নবজাতকের গোড়ালি থেকে রক্ত নিয়েও অদৃশ্য রোগ নির্ণয়

বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা: মৃত্যু কমাবে কেএমসি মাতৃসেবা

by glmmostofa@gmail.com

শিশু জন্মের পর গোড়ালি থেকেও রক্ত নিয়েও নির্ণয় করা যায় বেশ কয়েকটি অদৃশ্য রোগ।

নবজাতকদের পায়ের গোড়ালীর রক্ত পরীক্ষা করে ভবিষ্যৎ রোগ নির্ধারণ করার বিষয়টি বাংলাদেশে চালু করা গেলে অনেক রোগ থেকে তাদের মুক্ত রাখা সম্ভব হবে। যা নবজাতকদের জীবন রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে  বলে জানিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

তারা জানান, জন্মের আগেই নানা ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সন্তানের রোগ নির্ণয় করা যায়। তবে এগুলো দৃশ্যমান শারীরিক রোগ। তবে ব্যয় বহুল ওইসব টেস্ট সবাই করাতে পারেন না। এবার কম খরচে সারাদেশে সবার জন্য সহজ একটি রোগ নির্ণয় পদ্ধতি চালু করার দাবি জানান তারা।

বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে  বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে (বিসিএফসিসি) নবজাতকের ভবিষ্যৎ রোগ নির্ণয় ও সর্বাধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়ে ‘বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম’ (বিএনএফ) এর ৭ম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নবজাতক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এইসব  কথা বলেন। ২৩ ও ২৪ এপ্রিল দুইদিন ব্যাপি এ সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য ‘সুবিধা এবং বাড়িতে মানসম্পন্ন নবজাতক যত্ন: স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের পথ’।

এর আগে সকালে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক এমকিউ. কে তালুকদার।

দুই দিনব্যাপী এই আয়োজনে নিজেদের প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র উপস্থাপন করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ৭২১ জন এবং ৮ জন বিদেশি নবজাতক বিশেষজ্ঞ।

বিএনএফ’এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মনির হোসেনের সভাপতিত্বে  সম্মেলনে ইউনিসেফের ডেপুটি বাংলাদেশ প্রতিনিধি এমা ব্রিগ্রাম, বিএনএফএর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক নাজমুন নাহার, ফোরামের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. সঞ্জয় কুমার দে বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএনএফ এর সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. সুখময় কংস বণিক।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে একটি পলিসি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। পলিসি সেশনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘নবজাতকের পায়ের গোড়ালীর রক্ত পরীক্ষা করে ভবিষ্যৎ রোগ নির্ধারণে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. সঞ্জয় কুমার দে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারওয়ার বারী। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. মনির হোসেন সভাপতিত্ব করেন।  পলিসি ডায়ালগে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জন্মগত কিছু ত্রুটি আসে বাচ্চাদের। যেগুলো ৫/৭/১০ বছর বয়সে গিয়ে ধরা দৃশ্যমান হয়। তখন আর কিছু করার থাকে না। অথচ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এসব নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসা সম্ভব। খুব কম খরচে নবজাতকের গোড়ালি থেকে রক্ত নিয়ে এই টেস্ট করা যায়। গত ২৫ বছর ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটি ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করলে সারাদেশের টিকা দেওয়ার সময়ই বা জন্মের পরপরই গোড়ালি থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে কাগজে করে পাঠিয়ে দেবে। পরীক্ষা করে আমরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো।

তারা বলেন, এটি সহজ, কম খরচ এবং সবার জন্য নিশ্চিত করা যাবে। এর ফলে জীবন রক্ষার পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতা, থ্যালাসামিয়া, থাইরয়েডসহ অনেক নানা ধরনের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা সম্ভব।  ফিলিপাইনের প্রতিনিধি তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এ পর্যন্ত তারা এই পরীক্ষার মাধ্যমে ২৯টি রোগ নির্ণয় করতে পেরেছেন।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে ২৫ বছর আগে অধ্যাপক ডা. ফওজিয়া মুসলেম ও অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার শুরু করেছেন। এখন সবার জন্য কীভাবে করা যায়, এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা ইপিআই কার্যক্রম বেশ কার্যকর করেছি। সম্প্রতি করোনা ভ্যাকসিনেশনে সফলতা পেয়েছি।  একই পথে আমরা এই কাজটি করলেও সফলতা পাবো।

অনুষ্ঠানে  বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. সঞ্জয় কুমার দে বলেন, নবজাতকের পায়ের গোড়ালীর রক্ত পরীক্ষা করে ভবিষ্যৎ রোগ নির্ধারণ করার বিষয়টি বাংলাদেশে চালু করা গেলে নবজাতকদের অনেক রোগ থেকে তাদের মুক্ত রাখা সম্ভব হবে। যা নবজাতকদের জীবন রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে। একই সাথে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি জানা থাকলে সে অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা যাবে। যা নবজাতকদের দুর্ভোগ লাঘবসহ পরিবারের আর্থিক দিকও সাশ্রয় হবে। সর্বোপরি নবজাতকদের সুন্দর স্বাস্থ্যবান সুখকর জীবন নিশ্চিত হবে।

আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে নবজাতকদের নিয়ে বিশেষ  চিকিৎসাপদ্ধতির কথা তুলে ধরেন দেশি-বিদেশি  শিশুবিশেষজ্ঞরা।

 তারা জানান, সময়ের আগে বা স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন নিয়ে জন্ম নিলে জন্মের পর অন্তত প্রথম আট ঘণ্টা নবজাতককে মায়ের সঙ্গে রাখতে হবে। ত্বকের স্পর্শে রেখে নবজাতককে ঘন ঘন বুকের দুধ পান করাবেন মা। অত্যন্ত সহজ ও সাশ্রয়ী এই চিকিৎসাপদ্ধতিই বাঁচিয়ে দিতে পারে লাখো নবজাতকের প্রাণ। নবজাতককে দ্রুত সুস্থ করে তোলার অত্যন্ত কার্যকর এ পদ্ধতির নাম ‘ক্যাঙারু মাদার কেয়ার’ বা কেএমসি মাতৃসেবা। নামটি এসেছে ক্যাঙারু প্রাণী থেকে। প্রাণীটি নিজের পেটের নিচের দিকে থাকা প্রাকৃতিক থলেতে বাচ্চাদের নিয়ে চলাফেরা করে।

সম্মেলনে এই অনুষ্ঠানটি সহব্যবস্থাপনা করছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল–ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, নোরা হেলথ, প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও ওরবিস।

 উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক নাজমুন নাহার ও অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

অধিবেশনে অসুস্থ নবজাতক এবং জন্মগত জটিলতা থাকা শিশুদের সেবায় বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্রের (স্ক্যানইউ) চিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তুলে ধরেন ইউনিসেফের কোয়ালিটি কেয়ার বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পায়ে ফিও থান চো। তিনি বলেন, নবজাতকের কম ওজন, শ্বাসজটিলতা এবং সেপসিসের মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় স্ক্যানইউগুলো আধুনিকভাবে নকশা করা হয়েছে, যা অনেক শিশুর প্রাণ রক্ষা করবে।

কেএমসি মাতৃসেবা নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ইউনিসেফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জাহিদ হাসান। পদ্ধতিটির গুরুত্ব তুলে ধরে এই চিকিৎসক বলেন, জন্মের পর মায়ের বুকে শিশুকে এমনভাবে শুইয়ে রাখা হয়, যেন দুজনই একে অপরের ত্বকের স্পর্শে থাকে। জন্মের পর প্রথম ২৪ ঘণ্টা কেএমসি সেবার ফলে বিশ্বব্যাপী নবজাতকদের সেপসিস হওয়ার হার ১৮ শতাংশ কমেছে। এভাবে সারা বিশ্বে অনেক নবজাতকের প্রাণ রক্ষার নজিরের কথা জানান জাহিদ হাসান।

‘বাংলাদেশের নবজাতক স্বাস্থ্যের দৃশ্যপট: এখন কোথায় মনোযোগ দিতে হবে?’ শীর্ষক আলোচনা করেন ইউনিসেফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চিকিৎসক দেওয়ান মো. এমদাদুল হক। দেশে নবজাতকের মৃত্যু রোধে তাৎক্ষণিক কেএমসি মাতৃসেবার কার্যকারিতা নিয়ে কথা বলেন ইউনিসেফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার দে।

প্রধান অতিথি জাতীয় অধ্যাপক এম কিউ কে তালুকদার বলেন, নবজাতকের সেবায় দেশের তরুণ চিকিৎসক ও গবেষকেরা অনেক সম্ভাবনাময় কাজ করছেন। তাঁরা নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। দেশের সব মা ও শিশু যেন এই সেবাগুলো পায়, সেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সম্মেলনে বাংলাদেশে ইউনিসেফের ডেপুটি প্রতিনিধি ব্রিজেট জব-জনসন বলেন, ‘বাংলাদেশ নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এখনো প্রতি আট মিনিটে আমরা বয়স এক মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই এক নবজাতককে হারাচ্ছি। এই নবজাতকদের বেশির ভাগই নানা প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য ব্যাধি। যেমন অপরিপক্বতা (সময়ের আগে জন্ম), কম ওজন নিয়ে জন্ম, জন্মকালীন শ্বাসকষ্ট ও সংক্রমণের কারণে মারা যাচ্ছে।’

ব্রিজেট বলেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করা, স্ক্যানইউ স্থাপন, কেএমসি মাতৃসেবা সম্প্রসারণ, অক্সিজেন থেরাপি সেবা ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কমিউনিটিভিত্তিক ফলোআপ পরিষেবা প্রসারের মাধ্যমে নবজাতকের পরিচর্যা উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করছে ইউনিসেফ। আর এর সবকিছুই জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কৌশলের অধীন পরিচালিত হচ্ছে।

উদ্যোগগুলো আরও প্রসারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ব্রিজেট আরও বলেন, ‘প্রত্যেক মা ও শিশু, বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলেও যেন এসব সেবা পান। মা ও কিশোরীদের সহায়তা, তাঁদের পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসম্মত গর্ভকালীন বিরতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রতিরোধযোগ্য নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু চিরতরে বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অবশ্যই এই অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে হবে আমাদের।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com