নিজস্ব প্রতিবেদক।।
গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে হার্টের রিংয়ের (স্টেন্ট) নতুন দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। তবে নতুন ওই দাম বৈষম্যমূলক, এমন অজুহাত তুলে আমদানিকারকরা হাসপাতালগুলোয় রিং সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। ফলে সরকার নির্ধারিত দামে রিং পাচ্ছেন রোগীরা। সীমিত তিন কোম্পানির হার্টের রিং বাজারে পেলেও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। এই নিয়ে রোগীদের মধ্যে রোগীদের ভোগান্তির পাশাপাশি ক্ষোভও বাড়ছে। তাই রিংয়ের দাম সমন্বয়ে গতকাল রোববার সকালে দাম সমন্বয়ের জাতীয় কমিটি নিয়ে জরুরি এই বৈঠক করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা বৈঠকের পরও দাম নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান দিতে পারেনি জাতীয় কমিটি।
বৈঠকে জাতীয় কমিটি ১৩ সদস্যের বাইরে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে হার্টের রিং সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডাকা হয়নি। তাই দাম কার্যকরের ১৬ দিন পরও এই অচলাবস্থার অবসান হয়নি। ফলে এক রকম মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে এই দুই পক্ষ।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, যৌক্তিকভাবে স্টেন্টের দাম নির্ধারণ করেনি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রিং সরবরাহ বন্ধ রাখবো। আর রোগী দূর্ভোগের কথা অস্বীকার করেছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। তবে চিকিৎসা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, হার্টের রিং নিয়ে দেশে ‘অরাজক পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে। আর এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সমস্যা দেখা দেবে।
চিকিৎসকরা জানান, কারো হৃদপিন্ডে রক্ত সঞ্চালনে সংকুচিত হয়ে ব্লক বা বাধার সৃষ্টি হলে চিকিৎসক তাকে এক বা একাধিক রিং পরানোর পরামর্শ দিতে পারেন। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এতে মানুষ মারা যায়। রক্ত চলাচল বৃদ্ধির জন্য এই রক্তনালির ভেতরে বিশেষ ধরনের ডিভাইস বা কল স্থাপন করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম করোনারি স্টেন্ট। হার্টের রিং নামে এটা বেশি পরিচিত। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৫ জনকে স্টেন্ট লাগানো হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ১২ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর হার্টের রিং সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে। আর দাম নির্ধারণের মার্কআপ ফর্মুলা অনুযায়ী রিংয়ের কেনা মূল্যের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি রেখে দাম ঠিক করে দেওয়া হয়। যার মধ্যে ছিল আমদানি খরচ, মার্কেটিং, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ ও প্রফিট।
অধিদফতরের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত দামে স্টেন্ট বিক্রি করতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তিন কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘মার্কআপ ফর্মুলা’ অনুসরণ করা হলেও রিং সরবরাহকারী ইউরোপের ২৪টি কোম্পানিকে এ তালিকায় রাখা হয়নি। তারপর থেকেই হার্টের রিং সরবরাহ ও ব্যবহার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউরোপের ২৪টি রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানপন্থি বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত ব্যবসায়ীরা।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে জানা গেছে, হার্টের স্টেন্ট ব্যবসায়ীরা মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের তৈরি স্টেন্ট সরবরাহ করে। এই অংশ হাসপাতালে স্টেন্ট সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। ব্যবসায়ীদের আরেকটি অংশ স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। তারা ইউরোপসহ অন্য চারটি দেশে তৈরি স্টেন্ট আমদানি করে থাকে। এমনকি রিংয়ের মূল্য নির্ধারনের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছে ১১টি আমদানিকারক কোম্পানি। এই রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা আমদানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও হার্ট ফাউন্ডেশনে আসা রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম দামে ভালো মানের হার্টের রিংয়ের জন্য চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আবার অনেক কষ্টে মিললেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামের রিং। আর বাজারে থাকা তিন কোম্পানির হার্টের রিং অন্যান্য কম্পানির তুলনায় বেশি। বাধ্য হয়ে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাদের।
আর সংকট নিরসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হৃদরোগ বিভাগ থেকে উপাচার্যের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, গড়ে প্রতিদিন ৪০ টির মতো হার্টের রিং পরানো হতো। এখন দিনে ২৫ হচ্ছে। এ পর্যন্ত কয়েক জন রোগীর ব্লকের পরিমাপমতো রিং না পাওয়ায় অস্ত্রোপচারের কক্ষ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, হার্টের রিং ঘাটতির কারণে চিকিৎসা বন্ধ হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের রিং সরবরাহ আছে। তবে রিং লাগানোর সহযোগী সরঞ্জাম বা অ্যাকসেসরিজের (যেমন বেলুন, তার) সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে সমস্যার সমাধান না হলে সামনের দিনগুলোতে সংকট আরও বাড়বে। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করা জরুরী।
রোববার বৈঠকের পর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে উপপরিচালক মো. নুরুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, সংকট সমাধানে ব্যবসায়ীরা হাইকোর্টে গেছেন। এখন আদালত যে ধরনের নির্দেশনা দেবে তার আলোকে প্রয়োজনীয় কমিটি বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, হার্টের রিং যে প্রাইস ফিক্সড করা হয়েছে, সেটা জনস্বার্থে জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ যেহেতু বলছে প্রাইস সঠিক নয়, সে হিসেবে অভিযোগ করা হয়েছে এবং কোর্ট খোলার পর নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নতুন করে জাতীয় কমিটি কি আর কোনো নির্দেশনা দেবে- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনার পর আর কোনো সিদ্ধান্তের দরকার নেই। কারণ, সরকার যেটা করেছে জনস্বার্থেই করেছে।
তবে বৈঠকের পর নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট অব্যাহত রাখছে।
এ বিষয়ে ইউরোপীয় রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এক মালিক জিল্লুর রহমান বলেন, আজকের বৈঠকে আমাদের ডাকা হয়নি। কারণ আমরা জেনেছি, বৈঠকে বর্তমান সংকটের কোন সুরাহা হয়নি। আর না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ২৭ টি কোম্পানির মধ্যে তিনটি কোম্পানি ছাড়া বাকি ২৪ টি কোম্পানি সাথে যে বৈষম্য মূলক আচরণ করা হয়েছে তা কিভাবে জনগণের স্বার্থ উদ্ধার করে। টেকনিকেল কমিটির বাইরেও দেশে আরও অনেক ডাক্তার আছে তাদের মতামত নেওয়ার দাবি জানাই। আর বিশ্বের কোন দেশই মাত্র তিনটি কোম্পানির উপর নির্ভর করে চলে না।
মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেন, দাম নির্ধারণ করার বিষয়ে ঔষুধ প্রশাসনের অধিদফতর যে জনস্বার্থের কথা বলছে, আসলে জনস্বার্থে কিছুই হয়নি। বাংলাদেশে যে এত রোগী- যেখানে রিং এর দাম এখনো ৯০ হাজার টাকা, ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা এখনো আছে, সেখানে জনস্বার্থে কি করা হলো? আমাদের যে রিকোয়ারমেন্ট তার এক তৃতীয়াংশও পূরণ হচ্ছে না।
জাতীয় হৃদরোগ পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন বলেন, রিং কোনো সংকট এখনো দেখা যায়নি। তবে এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সমস্যা দেখা দেবে।
আর রিংয়ের দাম সমন্বয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখন যেহেতু বিষয়টি আদালতে রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়।