সরকারের পট পরিবর্তনের পরও থেমে নেই ওষুধের বাজারে নৈরাজ

দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১১০ শতাংশ

by glmmostofa@gmail.com
নিজস্ব প্রতিবেদক।। 
সরকারের পট পরিবর্তনের পরও থেমে নেই ওষুধের বাজারে নৈরাজ। প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে কোন না কোন ওষুধের দাম। যেন নিত্যপণ্যের দামের মতো ওষুধের দাম বাড়ানো একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই দফায় দফায় জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের দাম ইচ্ছেমতো বাড়াচ্ছে অনেক কোম্পানি।
গত কয়েকদিনে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিক ও ডায়াবেটিকসের ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনের দাম সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ পর্যন্ত। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। আর ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে  ১০ থেকে ১৫ টি কোম্পানির অন্তত  ৪৫ টি ওষুধের দাম বেড়েছে।
জানা যায়,  দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনসিয়াল ড্রাগসের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে উৎপাদিত মোট ওষুধের মাত্র ৩ শতাংশের দাম নির্ধারণ করতে পারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। বাকি ৯৭ ভাগের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো।
আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইচ্ছে মতো ওষুধ কোম্পানিগুলো মুনাফা করছে বলে অভিযোগ করেন পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা। তারা বলেন, এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। আর যেহেতু ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নাই। ফলে সেই সুযোগে যে যার মতো দাম বাড়াচ্ছে।
অথচ ওষুধের দাম বৃদ্ধি রোধে গত ২৯ এপ্রিল উচ্চ-আদালত থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।   সেইসঙ্গে অব্যাহতভাবে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ-আদালতের সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগীরা।
রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা জানান, লাগামহীনভাবে দাম বাড়ানোর ফলে তারা ক্রমেই জিম্মি হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের অবস্থা বেশি সূচনীয় হয়ে পড়ছে। আর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত একেকজন রোগীর প্রতি মাসে ওষুধ খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে অনেক সময় কাঁটছাট করে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। তবে ওষুধের দাম পেছনে ডলারের সংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন,ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। আর ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে  নজর দেওয়ার পাশাপাশি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার রাজধানীর ফার্মগেট, শাহবাগ বিপনী বিতান ও আজিজ কো-অপারেটিভ মেডিসিন মার্কেট,  মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার কয়েকটি ফার্মেসিতে ঘুরে  ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য গেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো
এসিআই লিমিটেড কোম্পানির গ্যাস্ট্রিক ও আলসার এবং  অস্টিওআর্থারাইটিস   রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স -৫০০ প্লাস ২০ মিলিগ্রাম প্রতি পিসের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে ২১ টাকা হয়েছে। শতকরা ১১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।  একই কোম্পানির    ব্যথানাশক ও জ¦র উপশমকারি ওষুধ  অ্যানাফ্লেক্স -৫০০ এমজি এস আর ট্যাবলেট প্রতি পিস ৯ টাকা থেকে ১৬ টাকা অর্থাৎ বেড়েছে  ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এই কোম্পানির পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ যা রক্তনালীগুলি সরু বা ব্লক জনিত সমস্যার কারণে ব্যবহৃত আরেক ওষুধ ফলুভার এক বক্স (১০ পাতা)  ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। শতকরা  হিসেবে ৪০  শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল্স পিএলসি কোম্পানির গ্যাস্ট্রিক ও আলসারজনিত সমস্যায় স্কয়ার কোম্পানির  ফ্যামোট্যাক ২০ মিলি গ্রামের এক পাতা ১২ টির  ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে। দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ।
একই কোম্পানির ডায়াবেটিকস  টাইপ -২ রোগীদের জন্য ব্যবহৃত এমজার্ড এম ৫/৫০০  এক পাতা ১০ টির  দাম ১৬৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে  ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এই কোম্পানির এ্যান্টিবায়োটিক ব্যাক্ট্রোসিন ২% অয়েনমেন্ট ১০ গ্রামের  বোতলের দাম ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এরিস্টো ফার্মা লিমিটেডের দাঁত ব্যথা কিং বা দাঁতে প্রদাহজনিত সমস্যায় মারভ্যান -১০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট এক বক্সের  (১০ পাতা) দাম ৪০০ টাকা খেকে বেড়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি পিস ট্যাবলেট ৪ টাকা থেকে বেড়ে ৭ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ।
সার্ভিয়ার বাংলাদেশ অপারেশন নামের এক কোম্পানির রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ব্যবহৃত  ডাইমাইক্রন এমআর ৩০ মিলিগ্রামের  ট্যাবলেট এক বক্স (৩০টি) দাম ৩৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৪২০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এ্যাজমা ও ফুসফুসজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ডক্সোমা ট্যাবলেট এক বক্সের (৫০ টি) দাম ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। টিস্যু জাতীয় সমস্যার জন্য নুভিসতা ফার্মা লিমিটেডের ট্যাবলেট ডাইনোজেস্ট ২ মিলিগ্রামের এক পাতার ১০ টির দাম ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
ডিসমেনোরিয়া রোগের চিকিৎসায় নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেডের ডাইড্রোন- ১০ মি.গ্রামের  ট্যাবলেট  এক বক্সের (৩০ টি) দাম ৯০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
মিটফোর্ড এলাকার আলিফ-লাম-মিম ফার্মা থেকে ওষুধে কিনতে এসেছেন সাইদুর রহমান নামে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত  এক রোগী। তিনি  বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং আমার হাঁপানির সমস্যায় ভুগছেন। তাই ডায়াবেটিসে ইনসুলিন, স্ট্রিপস কৌটা, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টরে ওষুধ  মন্ট্রিলসহ প্রতিমাসেই ওষুধ কিনতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিকসহ সব ওষুধের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু আমাদেও ইনকাম তো বাড়েনি। আর এভাবে বাড়তে থাকলে তো ওষুধ না খেয়েই মরতে হবে।
ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আলিফ-লাম-মিম ফার্মার এক কর্মচারি বলেন, আমাদের তো কিছু করার নেই। কোম্পানি দাম বাড়লে তো আমাদেরকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু কাস্টমার সাথে ঝামেলা পোহাতে হয় আমাদের।
শাহবাগের পপুলার মেডিসিন সেন্টারের  দোকানি  সঞ্জয় কুমার  বলেন,  দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও কম-বেশি কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ফামের্সীর  হতদরিদ্র মানুষের কথা বাদ দিলেও এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। যেহেতু দেশের মধ্যে নতুন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই হয়তো এ বিষয়ে কারো নজরদারি নেই। প্যাকেটের গায়ে কোম্পানির লেখা দাম অনুযায়ী আমরা বিক্রি করি। কিন্তু  দাম বাড়ার কারণে ওষুধ বিক্রিতে গিয়ে আমাদেরকেও  অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়।
ফার্মগেট এলাকার সুনান ফার্মা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক সৈয়দ সাদিকুল ইসলাম  বলেন, ওষুধের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নেই। অথচ নিত্যপণ্যের দাম দাম সারাদেশে হৈচৈ হয়। পত্রিকায় লেখালেখি হয়। এখন কোম্পানি দাম বাড়ালে আমাদেরকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এছাড়া তো কোন উপায় নেই। ওষুধে দাম বাড়াতে আমরা ভুক্তভোগী।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামালের খরচ যেমন বেড়েছে। তেমনি ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে ওষুধ উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন, কর্মচারি খরচ, গ্যাস-বিদ্যুত বা জ্বালানি খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।কিন্তু সেই তুলনায় ওষুধের দাম খুব বেশি বাড়েনি।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী  এবং জনস্বাস্থ্যবিদ  অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ওষুধের দাম বাড়লে সাধারণ ভাবেই মানুষের উপর এক ধরনের প্রভাব পড়ে। বাজারে কোম্পানিগুলো মধ্যে দাম বাড়াতে  এক ধরনের অনৈতিক প্রতিযোগতা চলছে। যদিও ডলার সংকটসহ নানা ধরনের খরচ বাড়ছে। কিন্তু তারপরও ওষুধ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা কতটুকু যৌক্তিত সেই প্রশ্ন রয়েছে।  আর দাম বাড়ার কারণ হচ্ছে  সরকারের  যে ওষুধনীতি রয়েছে তা কার্যকর হয়নি। গুণগত মান সম্মত ওষুধ নিশ্চিত করার  কথা থাকলেও তা হয়ে উঠেনি। তাই  দাম  নির্ধারণে সবাইকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। এজন্য আইনও লাগবে প্রয়োগও লাগবে, মানুষকেও সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে একটা সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। অর্থাৎ দাম নিয়ন্ত্রণে সুদিষ্ট কর্মকৌশল গ্রহণ করা ছাড়া কখনই নিয়ন্ত্রণে করা যাবে না।
এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন  বলেন, বিগত কয়েক মাসে বেশ কিছু  ওষুধের বাড়ছে। সেটি হয়ত ৫ থেকে ৭ শতাংশ। আসলে এ দাম বাড়ানো বললে ভুল হবে আসলে তা দামটা সমন্বয় করা হয়েছে। কারণ এক সময়ে ডলার ছিল ৮০ টাকা রেটে সেটি এখন বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। এছাড়াও কাঁচামাল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ওষুধ উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিবহনসহ অনেক খরচই বেড়েছে।  আবার অনেকেই  ওষুধের দাম বাড়তে আবেদন করেছেন। তবে এটি চলমান প্রক্রিয়া।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com