রাসেলস ভাইপার’ সাপ নিয়ে জরুরি নির্দেশনা 

কখনোই তেড়ে এসে কামড়ায় না, আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ 

by glmmostofa@gmail.com

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

এখন দেশজুড়ে এক  আতঙ্কের নাম  ‘রাসেলস ভাইপার’ সাপ। যা মূলত বাংলাদেশে ‘চন্দ্রবোড়া’ বা ‘উলুবোড়া’ সাপকেই রাসেলস ভাইপার  নামে ডাকা হচ্ছে।  আর রাসেলস ভাইপার’ সাপ নিয়ে আতঙ্কের কারণে  জরুরি নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন। নির্দেশনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশের সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুদ রাখার পাশাপাশি কোনও অবস্থাতেই যেন অ্যান্টিভেনমের স্টক খালি না থাকে, সেই নির্দেশনাও দেন।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রাণিবিদ্যা এবং পরিবেশবিদরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার সাপ কেন কোন সাপই কখনোই তেড়ে এসে কামড়ায় না। অন্য সব সাপের মতই নিজেকে রক্ষা করতে এবং ভয় পেয়েই দংশন করে। ফলে এক ধরনের ভুল ধারণা থেকে অযথাই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। মানুষকে আতংকিত করা হচ্ছে। কিন্তু এতে আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই। কারণ সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে এ সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়।

তারা বলছেন,  সতর্ক থাকলে সাপও বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে। না বুঝে সব সাপ মেরে ফেললে বাস্তুসংস্থানের ওপর চাপ পড়বে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে। তাই এই মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়ানোর চেয়ে সচেতনতা ও সতর্কতা জরুরি। একই সঙ্গে জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও অ্যান্টিভেনম টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বন্যার কারণে এ সাপ ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে। বিশেষ করে বন্যা ও নদীর পানিতে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশে ঢুকছে। আর যেহেতু চন্দ্রবোড়া সাপ অধিক প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং এই সাপ ডিম না দিয়ে একসঙ্গে ২০ থেকে ৮০টি পর্যন্ত জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করতে পারে। ফলে খুব সহজে এসব বাচ্চা বন্যার পানির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। পরবর্তীতে পূর্ণবয়স্ক হয়ে আবারও বংশবিস্তার করছে।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন,  সাপের জাত  না চিনেই জেনেই মেরে ফেলা হচ্ছে। যা খুবই দু:খজনক। মূলত বাংলাদেশে ‘চন্দ্রবোড়া’ বা ‘উলুবোড়া’ সাপকেই রাসেলস ভাইপার  নামে ডাকা হচ্ছে। অনেকেই বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপ ভারত থেকে ভেসে বাংলাদেশে এসেছে এবং এটি মাঝখানে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এ ধরনের  তথ্যে তেমন কোন ভিত্তি নেই। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশই হচ্ছে এই সাপের আদি বাসস্থান।

শনিবার (২২ জুন)  সকালে সারা দেশের সিভিল সার্জন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বিভাগীয় পরিচালক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকসহ দেশের সমগ্র স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে জরুরি ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনি এসব নির্দেশনা দেন।

সভায় স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রফেসর ডা. রুবেদ আমিনসহ স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

এসময় মন্ত্রী দেশের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালকদের সাথে সর্পদংশন ও রাসেলস ভাইপার নিয়ে কথা বলেন এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির খোঁজ খবর নেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রাসেলস ভাইপার নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি জনগণকে বলব, আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। রাসেলস ভাইপারের যে অ্যান্টিভেনম সেটা আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আমি পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছি কোনও অবস্থাতেই অ্যান্টিভেনমের ঘাটতি থাকা যাবে না।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সর্পদংশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। অনতিবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে এক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

ডা. সামন্ত লাল সেন এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য প্রচার প্রচারণার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন সর্পদংশনের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা খুবই জরুরি। রোগীকে হাসপাতালে আনতে যাতে দেরি না হয় সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

এছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী সভায় সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের নিজ নিজ এলাকার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার তাগিদ দেন।

বেসরকারি সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনও বলছে, বাংলাদেশে ‘রাসেলস ভাইপার’ থেকেও অনেক বিষধর সাপ রয়েছে। সবচেয়ে বিষধর সাপ হিসেবে রাসেলস ভাইপারের নাম প্রচার করা হলেও কেউটে সাপ কিংবা গোখড়া সাপ রাসেলস ভাইপারের চেয়েও বেশি বিষধর সাপ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান  বলেন, দেশ থেকেই কখনই চন্দ্রবোড়া সাপ বিলুপ্ত হয়নি।  বরং গত পাঁচ বছর ধরেই দেশে এই সাপের পপুলেশন খুব ভাল। আর পপুলেশন বাড়ারও বেশ কিছু উপাদান রয়েছে। এই সাপ সাধারণত নদী অববাহিকায় বাস করে। আর বাংলাদেশে অনেক এলাকায় যেহেতু নদী অববাহিকা রয়েছে তাই ওই সব এলাকার  গ্রামাঞ্চলের ধানক্ষেত ও ফসলের জমিতে বিচরণ বেশি। তাই এই সাপের সংখ্যাও বেড়েছে এবং  মানুষের চোখে পড়ছে। আর আর এটা যেহেতু খুবই বিষধর। তাই কৃষকরা ক্ষেতে খামারে কাজ করলে গেলে বা কোন ভাবেই এই সাপের কাছে গেলে কিংবা তার গায়ে পা লাগলে অন্য সব সাপের মতই দংশন করে। কিন্তু কখনই তেড়ে এসে কামড়ায় না। কিন্তু   এদের ‘ভেনম’ খুব দামি।

তিনি বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপ সাধারণত কৃষি জমিতে ইঁদুর, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ অন্যান্য প্রাণী খেয়ে থাকে। এছাড়া সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। চন্দ্রবোড়া সাপ দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।প্রথমত  চন্দ্রবোড়া সাপ চিনতে হবে। এর সাপের মাথা হবে ত্রিকোণাকার, মুখ খুব চোকা প্রকৃতির। মাথা ও ধড়ের মাঝে গলাটা চিকন ।এটার সঙ্গে অজগর, স্যান্ডবোয়ারের মিল আছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই গায়ের যে চাকা চাকা  গোল গোল দাগগুলো তা একটা থেকে আরেকটা খুবই ভিন্ন কোন মিল নেই এবং যা দাগগুলোর ভিন্নতা চোখে পড়বে।এই অধ্যাপক বলেন, এই সাপ যদি ভালভাবে  কামড়ালে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যু হতে পারে।  তাই যত দ্রুত সম্ভব বিশেষ করে দুই ঘন্টার মধ্যেই অ্যান্টিভেনম নিতে হবে। তাই কামড় দেওয়ার সাথে সাথে দেরি না করে এবং কাউকে ডাকাডাকি না করে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। যত বেশি  নড়ানড়া করবে ততই ঝুঁকি বাড়বে।  এছাড়াও রাসেলস ভাইপার সাপ রক্তে আক্রমণ করে। আর  এদের  বিষে থাকে ‘হেমোটক্সিন’ জাতীয় এক ধরনের পদার্থ। যা রক্তের জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

নানা কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাসেলস ভাইপার সাপের উপস্থিত কিছুটা বেড়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও পরিবেশবিদ   অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার  বলেন,  নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমি ধ্বংশ এবং প্রাকৃতিক প্রাণী আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত নানা কারণে  পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আর বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণেই রাসেলস ভাইপার সাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বের হয়ে আসছে। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।  কিন্তু সাপ আতংকে সাপকে মেরে ফেলার মাধ্যমেই এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সঠিক সমাধান নয়।  অযথাই মানুষের মধ্যে আতংক ও ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। যা ঠিক নয়। তাই বন্যপ্রাণী দেখলেই অকারণে তা হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ সাপ বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রাণী। ফলে সাপ মারা দণ্ডনীয় অপরাধ।

সম্প্রতি গুজব ছড়িয়ে যে রাসেলস ভাইপার দংশন করলে অ্যান্টিভেনাম দিলেও রোগী মারা যায়। আর এই বিষয়টি সত্য নয় জানিয়েছেন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ। তিনি  বলেন, মানুষকে জ্ঞানের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করতে হবে । কারণ অনেক শিক্ষিত মানুষও গুজব ছড়াচ্ছে ফলে তাদেকে দ্বায়িত্বশীল হতে হবে। গ্রামের খেটে খাওয়া কখনো ভুল তথ্য দিতে পারে না। বরং সময় মতো অ্যান্টিভেনাম নিলে  বেশিরভাগ রোগীই সুস্থ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘রাসেলস্ ভাইপার বা কোন সাপেই নিজ থেকে তেড়ে এসে দংশন করে না। কেবল উত্ত্যক্ত করলেই নিজ রক্ষার্থে দংশন করে। তেড়ে এসে দংশন করার প্রশ্নেই আসে না। চন্দ্রবোড়া সাপ যে সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিকাজে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কর্মস্থলে সাপ আছে কিনা দেখে নিতে হবে।

ডা. মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ  বলেন, এই উপমহাদেশে সাপের দংশনের ঐতিহ্যগত চিকিৎসা (ওঝা) প্রচলিত ছিল। আমার চিকিৎসার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, মানুষ সাপে কামড় দেওয়ার পর সর্বপ্রথম যায় ওঝার কাছে। পরে একেবারেই শেষ সময় আমাদের কাছে আসে। অথচ সময় হচ্ছে এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত সময়ে রোগীকে উপজেলা হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে আসা দরকার। কারণ  এই সাপ কামড়ালে রক্তজমাট বাঁধার ক্ষমতা নষ্ট করে এবং অভ্যন্তরীণ রক্তপাত সৃষ্টি করে। বিষে থাকা কিছু উপাদান কিডনিরও ক্ষতি করে। যা দংশনের পর থেকে সময় বাড়ার সাথে সাথে কিডনি ফেলিওরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আবার কিছুক্ষেত্রে স্বল্প মাত্রায়  ‘নিউরোটক্সিন’ এর প্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির স্নায়বিক সমস্যাও তৈরি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আসলে রাসেলস ভাইপারের বিষে অনেকগুলো জটিল উপাদান রয়েছে। দেরি করলেই এখানে সমস্যা তৈরি হয়। তাই সাপে কামড়ালে  কোনভাবেই অবহেলা  কিংবা দেরি করা যাবে না। অঙ্গটি অচল করে এবং দ্রুত পরিবহণের ব্যবস্থা করে উপজেলা-জেলা ও নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে। কারণ সঠিক সময়ে চিকিৎসায় বেশির ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যান। বিনামূল্যে এন্টিভেনমসহ বিভিন্ন সামগ্রী বাংলাদেশ সরকার হাসপাতালে সরবরাহ করেছেন। কোন রাসায়নিক সামগ্রী দিয়ে সর্প দংশন কিংবা সাপকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। রাসেলস্ ভাইপারসহ কোন   সাপ মারা ঠিক  না। এরা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। মানুষের উপকার করে। তাই রাসেলস্ ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com