বিশ্ব থাইরয়েড দিবস আজ। শরীরের ছোট একটা গ্রন্থির নাম ‘থাইরয়েড’। যার কাজ মূলত শরীরের কিছু অত্যাবশকীয় হরমোন (থাইরয়েড হরমোন) উৎপাদন করা। অথচ বিশ্বের প্রায় ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ এই থাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত। অর্থাৎ বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু বাংলাদেশে কত মানুষ আক্রান্ত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।যদিও থায়রয়েড টাস্কফোর্স ও বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির তথ্যমতে, বিভিন্ন ধরনের থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন দেশের প্রায় ৪ কোটির বেশি মানুষ । তাদের মধ্যে তিন কোটি মানুষ সমস্যাটি সম্পর্কে জানেনই না। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার আওতার বাইরে এবং জানেই না তারা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে ৪ শতাংশের বেশি গভবর্তী মহিলা থাইরয়েডে ক্যান্সারে আক্রান্ত। যা আগে ছিল এক শতাংশের মতো। আর আট শতাংশ রোগী সাব-ক্লিনিক্যাল হাইপোথাইরোডিসম সমস্যায় ভুগছেন। থায়রয়েড আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি দশজনের মধ্যে ৯ জনেই নারী। প্রতি ২ হাজার ৩০০ শিশুর মধ্যে একজন জš§গত থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মূলত গলার সামনের দিকের উঁচু হাড়ের নিচে ‘থাইরয়েড’ গ্রন্থিটি অবস্থিত । এটি প্রজাপতিসদৃশ এবং ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালিকে পেঁচিয়ে থাকে। আবার শরীরে এই থাইরয়েড হরমোনের একটা নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার চাইতে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলেই শরীরেনানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। যেমন শরীরে থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হলে বলা হয় ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’ এবং বেশি উৎপন্ন হলে বলা হয় ‘হাইপারথাইরয়েডিজম’।
তারা বলেন, এই রোগ বিস্তারে বংশগতির অনেক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে পরিবাবার মধ্যে যেমন দাদি, নানি বা মায়ের থাইরয়েডে সমস্যা থাকলে ৭০ শতাংশর ক্ষেত্রে শিশুদের ও আত্মীয়স্বজনদের থাইরয়েড সমস্যার ঝুকি থাকে। এমনকি বাড়ন্ত শিশুরাও থাইরয়েড হরমোন ঘাটতিতে ভুগতে পারে। তাই সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের।
এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে আজ বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আপনার থাইরয়েডকে জানুন,রোগের শুরুতে নির্ণয় করুন, সুস্থ থাকুন’ । সারা বিশ্বে ২০০৯ সাল থেকে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উদ্যোগে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি বহির্বিভাগে প্রাথমিক হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত রোগীদের উপর পরিচালিত হয়। ২ হাজার ৬৪১ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
গবেষণায়, এই রোগীদের বয়স ৩৭ বছরের মধ্যে ছিলো, তারা অন্তত ৫ বছর ধরে এই রোগে ভুগছেন। গবেষণায় দেখা যায় ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ নারী হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগছেন। গবেষণায় হাইপোথাইরয়েডিজমের সবচেয়ে সাধারণ কারণ ছিল হাশিমোটো’স থাইরয়ডাইটিস (৪ দশমিক ৯ শতাংশ)। ১ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর মধ্যে ডিফারেনশিয়েটেড থাইরয়েড ক্যান্সার ছিল এবং ৪০ দশমিক ২ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রোগের কারণ নির্ধারিত হয়নি। ডিফরেনশিয়েটেড থাইরয়েড হলো এক ধরণের থাইরয়েড ক্যান্সার যেখানে মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখলে ক্যান্সার কোষগুলি স্বাভাবিক থাইরয়েড কোষের মতো দেখায়।
এ গবেষলার সাথে যুক্ত ছিলেন এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট ক্যান্সারের আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ৪ শতাংশের বেশি গভবর্তী মহিলা থায়রয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত। তারা বাচ্চা প্রসবের জন্য আমাদের গাইনি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। অথচ আগে ধারণা ছিল এক শতাংশের বেশি গর্ভবর্তী মহিলা থায়রয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত। অর্থাৎ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যা খুবই উদ্বেগজনক। অথচ তারা সবাই জানাতো যে থায়রয়েডে আক্রান্ত। আমাদের এখানে নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। আবার যারা থায়রয়েডে আক্রান্ত কিনা সে বিষয়ে জানতো না এবং কখনই চিকিৎসা করেনি তাদের মধ্যেও ৮ দশমিক ৬ শতাংশ ‘হাইপোথাইরয়েডিজমে’ আক্রান্ত।
তিনি বলেন, ভ্রুণ অবস্থা থেকে আমৃত্যু থায়রয়েড হরমোনের প্রয়োজন অপরিহার্য। গর্ভকালীন মা ও গর্ভস্থ শিশুর নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে। এখন কেউ যদি জানে তাহলে তার বাচ্চার জন্য চরম ক্ষতিকারক। কিন্তু সমস্যা হলো হরমোনের চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের দেওয়া কথা থাকলেও রোগীর সংখ্যা তো বেশি। তাই আমরা থায়রয়েডের রোগী এবং এ রোগের যারা চিকিৎসা দেন সবার জন্যই একটি গাইড লাইন তৈরি করেছি। যাতে তারা সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দেন। যা আন্তজার্তিক জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গাইড লাইন মেনে চিকিৎসকদের চিকিৎসা কঠিন হলেও রোগীদের চিকিৎসার সুবিধার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
থাইরয়েডের হরমোন ঘাটতি প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন্ডোক্রাইনোলজী বিভাগের চিকিৎসক ডা. মঈনূল ইসলাম বলেন, মূলত থাইরয়েড রোগের পেছনে বংশগত কিছু প্রভাব রয়েছে। যেহেতু এটি হরমোনের সাথে জড়িত। থাইরয়েডের হরমোন ঘাটতি হলে শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।এক সময়ে মনে করা হতো শরীরে আয়োডিনের ঘাটতির কারণে এ রোগ হতো। সাধারণত মহিলারা এ রোগে আক্রান্ত হন বেশি। শরীরে হরমোনের ঘাটতি থাকলে তা ধীরে ধীরে উপসর্গ দেখা দেয়। আবার অনেক সময়ে দেখা যায়না।
তিনি বলেন, থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলেও বেশির ভাগ রোগী সমস্যা বুঝতে পারে না। এ রোগের কারণে অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ, অবসাদ, স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া বা কমে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, অনেক সময় মুখ ফুলে যেতে পারে এবং গলার স্বর বদলে যেতে পারে। এছাড়াও মহিলাদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত মাসিক বা অতিরিক্ত মাসিক, গর্ভ ধারণে অক্ষমতা, অকাল গর্ভপাত প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই থাইরয়েড সন্তান জন্মের পরপরই, বয়ঃসন্ধিকালে, নারীদের গর্ভধারণের আগে ও বয়স ৪০ হওয়ার পর থাইরয়েড স্ক্রিনিং প্রয়োজন। একইসঙ্গে সবাইকে এই রোগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।