চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলে মিলে না প্রসবকালীন চিকিৎসা সেবা

মা-শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে

by glmmostofa@gmail.com

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি।।

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বছরের পর বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে চরবাসীর জন্য মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা বলে কিছুই নেই। সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করলেও সেখানে প্রসূতি সেবা দূরের কথা, সাধারণ চিকিৎসাসেবাও চরবাসী পান না। সারাবছরই তাদের বাসক রতে হয় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে। সন্তান প্রসবের মতো জরুরি মুহূর্তগুলোতে রোগী ও স্বজনদের ছুটতে হয় শহরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে পথেই ঘটে যায় হৃদয় বিদারক দুর্ঘটনা।
স্থানীয়রা বলছেন, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বরাবরই বঞ্চিত চরাঞ্চলের নারীরা। তাদের কাছে পৌঁছায়নি মাতৃ স্বাস্থ্যসেবার ন্যূনতম সুবিধাও। ফলে নদী বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকা হওয়ায় চরাঞ্চলের বেশিরভাগ নারীই মৃত্যু ঝুঁকি আছে জেনেও বাধ্য হন বাড়িতেই সন্তান প্রসবে। ফলে প্রায়ই ঘটতে শোনা যায় মা বা নবজাতক মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এটাই যেন নিয়তি তাদের।
দুর্ভোগের এই অভিজ্ঞতা চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদী বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের সব গর্ভবতী নারীর জীবনেই। সরকারি-বেসরকারি কোনো চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা না থাকায় সারাবছরই তাদের বাস করতে হয় এরকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে; যেখানে নদী পারাপারের সময়ই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মারা যান মা অথবা নবজাতক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারায়ণপুর ইউনিয়নের মোড়লপাড়া চরের খুদেজা ও বশির দম্পতি। গত ২৫ ডিসেম্বর রাত ৩টায় স্ত্রীর প্রসব ব্যথা উঠলে আর সবার মতো তারাও স্থানীয় দায়মা ও কথিত পল্লী চিকিৎসকের আনাড়ি হাতেই সঁপে দেন মা ও অনাগত সন্তানের জীবন। কিন্তু নরমাল ডেলিভারি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠে পড়েন শহরমুখী একমাত্র বাহন নৌকায়। বিশাল পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে বিকেল ৩টায় পৌঁছান জেলা সদরের একটি ক্লিনিকে। শুরু হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নানান শারীরিক জটিলতা নিয়েই এক পর্যায়ে খাতিজাকে আত্মসমর্পণ করতে হয় ডাক্তারের ছুরি-কাঁচির নিচে। রাত ৮টায় সিজারের মাধ্যমে তিনি জন্ম দেন একটি পুত্র সন্তান। এভাবেই ১৭ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর এক মরণ যাত্রার মধ্য দিয়ে জীবনে দ্বিতীয়বার মা হওয়ার স্বাদ নিতে হয় এই চরবাসী নারীকে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরের ইউনিয়নগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো যেন দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত ভবনের মতো। সেখানে না মেলে ডাক্তার, না মেলে ওষুধ। যেখানে সন্তান প্রসবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবার ব্যবস্থা থাকা অতি জরুরি, সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাই মিলছেনা।
অভিযোগ উঠেছে, এসব ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার, সিএইচসিপিরা নিয়মিত বসেন না। বেশিরভাগ সময়ই থাকে বন্ধ। প্রতিদিন সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও কেউ আসেন সপ্তাহে বা মাসে এক বা দুইদিন। কেউ আবার কখনই আসেন না।
চরবাসীর জীবন মানেই সংকটময় এক দুরূহ-দুঃসহ জীবন। ভয়াবহ বন্যা আর নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারানো খানকার মানুষজনের সারা বছরের দুঃখ-গাথা। তাই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে সেখানে সন্তান প্রসবের মতো জরুরি সেবার জন্য আধুনিক আয়োজনসহ অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দাবি চরবাসীর।
অনুসন্ধানে জানা গেল, এসব কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত না করে এখানকার ডাক্তার, নার্স, স্যাকমো ও ফার্মাসিস্টরা সবাই জেলা শহরের বিভিন্ন ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে কর্মরত থাকেন প্রেষণে। মানেন না প্রেষণের নিয়ম-নীতিও।
শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. নুরে জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, জাতীয় প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ সমিতির হিসাব বলছে, এখনও দেশের চরাঞ্চলের ৪৮ শতাংশ মা বাড়িতেই সন্তান জন্ম দেন। আর ৩০ ভাগ মা গর্ভধারণকালে কখনও হাসপাতালেই যান না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলে এ সংখ্যা আরো বেশি। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা।
এ ব্যাপারে পাঁকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মালেক বলেন, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে কাজে আসছে না এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো। এরজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের সুশাসনের অভাবকেই দায়ী করছেন তারা। পাশাপাশি চরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ বরাদ্দেরও দাবি তাদের।
সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সিনিয়র মেডিকেল স্পেশালিষ্ট ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফাবেযা রহমান জানান, চরাঞ্চলের গর্ভবতী নারীরা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অসচেতন। তাই মা ও অনাগত সন্তানের মৃত্যু ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। ফলে এসব পরিস্থিতিতে দীর্ঘকালীন মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভোগেন এসব মা।
নারায়নপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. মুশফিকুর রহমান জানান, অবকাঠামোগত সমস্যা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন না থাকার কারণে সেখানে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমি জেলা শহরের ২৫০-শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. এসএম মাহমুদুর রশিদ জানান, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে এসব চরাঞ্চলে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছেনা প্রসূতিকালীন স্বাস্থ্যসেবা। তবে যাদের সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা ঠিকমতো না গেলে খোঁজখবর নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

You may also like

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

গ্রেটার ঢাকা পাবলিকেশন নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স ৪৪/১, রহিম স্কয়ার

নিউমার্কেট, ঢাকা ১২০৫

যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@pran24.com