নিজস্ব প্রতিবেদক।।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচলা এলাকায় সিলিন্ডারের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসে আগুন লেগে অন্তত ৩৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪ জনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় আজ বুধবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যায় ওই ঘটনা ঘটে।
অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে হাসপাতালে যে ৩৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে তাদের মধ্যে সোলাইমান মোল্লার(৪৫)৯৫শতাংশ , মোতালেব হোসেনের (৪৮) ৯৫শতাংশ, মহিদুলের(২৫)৯৫শতাংশ, গোলাম রাব্বীর(১৩) ৯০শতাংশ, নার্গিসের(২৫) ৯০শতাংশ, ইয়াছিন আরাফাতের(২১) ৮৫শতাংশ, লাদেনের(২২) ৮৫শতাংশ, তায়েবার(৩)৮০ শতাংশ, মো. সোলাইমানের(৬)৮০ শতাংশ, আব্দুল কুদ্দুসের(৪৫) ৮০শতাংশ, কোমেলা খাতুনের (৮০) ৮০শতাংশ, নিলয়ের(১০) ৮শতাংশ, মো. আরিফের(৪০) ৭০শতাংশ, জহুরুল ইসলাম কুটির (৩২) ৫৮শতাংশ, মশিউরের(২২) ৫২শতাংশ, সাদিয়া খাতুনের(১৮) ৫শতাংশ, নুরনবীর(৫) ৫শতাংশ, কবির হোসেনের(৩০) ৪৫শতাংশ, মুন্নাফের(১৮) ৪০শতাংশ, মো. নাঈমের (১৩) ৪০শতাংশ, লালনের (২৪) ৪০শতাংশ, নিরবের(৭) ৩২শতাংশ, রামিছার(৩৬) ৩শতাংশ, আজিজুলের (২৪) ৩শতাংশ, শিল্পির (৪৫) ২৫শতাংশ, সুমনের(২৫) ২৫শতাংশ, তারেক রহমানের (১৮) ২০শতাংশ, মিরাজের(১৩) ১৫শতাংশ , মনসুরের(৩০) ১০০শতাংশ, সুফিয়ার(৯) ১০শতাংশ, শারমিনের (১১) ১০শতাংশ, রাহিমার (১০) ১০শতাংশ এবং রতনার(৪০) ১ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সহকারী পরিচালক হোসাইন ইমাম ইমু জানান, গাজিপুর থেকে নারী শিশু সহ ৩৪ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে আসছে। এদের মধ্যে ১৬অবস্থা আংশকাজনক। বাকিদের অবস্থাও শংঙ্কামুক্ত না। এদের মধ্যে ৫ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার তেলিরচালা টপস্টার কারখানার পাশে শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী জমি ভাড়া নিয়ে কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। ওই বাড়িতে থাকা সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেলে পাশের একটি দোকান থেকে শফিকুল নিজেই একটি গ্যাস সিলিন্ডার কিনে আনেন। সেই সিলিন্ডার লাগানোর সময় সিলিন্ডারের চাবি খুলে গিয়ে পাশের চুলা থেকে আগুন ধরে যায়। এ সময় আশপাশের উৎসুক নারী, পুরুষ ও শিশুদের শরীরে আগুন লেগে যায়। এতে অন্তত ৩৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। পরে আশপাশের লোকজন আগুন নিভিয়ে তাদের উদ্ধার করে কোনাবাড়ী এলাকার কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরে তাঁদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুরের কোনাবাড়ী কলেজের উল্টো পাশে টপস্টার কারখানা। ওই কারখানার পশ্চিম পাশে টিনের বেড়া দিয়েছে গড়ে উঠেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। সেখানে বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিকেরা বসবাস করেন। ওই বাড়িতে থাকা সিলিন্ডারের গ্যাসের ছিদ্র থেকে আগুন ধরে যায়। ঘটনার পর থেকে সেখানে ভিড় করতে থাকেন মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, তাদের পাশের বাড়িতে একটি সিলিন্ডার ছিদ্র হয়ে গ্যাস বের হচ্ছে, এ খবর পেয়ে সেখানে লোকজন জড়ো হন। একপর্যায়ে আগুন ধরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে থাকা ওই ৩৬ জন দগ্ধ হন।
বাড়ির মালিক শফিকুল ইসলাম জানান, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়নি। সিলিন্ডারের ত্রুটির কারণে গ্যাস বের হতে থাকে। হঠাৎ পাশের চুলা থেকে সিলিন্ডারে আগুন ধরে যায়।
কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক সাইফুল আলম বলেন, দগ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
খবর পেয়ে রাত আটটার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউছার আহাম্মেদ, কালিয়াকৈর থানার ওসি এ এফ এম নাসিমসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ইউএনও কাউছার আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে যতদূর জানতে পেরেছি, একটি গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ হয়ে পাশের চুলা থেকে আগুন ধরে যায়। তখন বাড়ির মালিক আতঙ্কিত হয়ে সিলিন্ডারটি ছুড়ে মারেন। এ সময় পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দাসহ ৩০ জনের মতো দগ্ধ হয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।
কালিয়াকৈর থানার ওসি এ এফ এম নাসিম বলেন, স্থানীয় দোকান থেকে সিলিন্ডার পরিবর্তন করে নিয়ে এসে লাগানোর সময় পাশের চুলা থেকে আগুন ধরে যায়। আগুনে দগ্ধ হয়ে ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। ঘটনাটির তদন্ত করা হবে। এতে কারও গাফিলতি থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খবর পেয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছুটে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। তিনি চিকিৎসকদের দগ্ধ ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দেন।গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাসের আগুনে এত বেশি মানুষের দগ্ধ হওয়ার পেছনে কৌতূহলী হয়ে ভিড় জমানোর তথ্য মিলেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা জানান, যে বাসায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে গ্যাস বের হতে থাকা গরম সিলিন্ডার ভেজা চট দিয়ে মুড়িয়ে বাইরে রেখে যান পরিবারের কেউ একজন। স্থানীয়দের অনেকে কী হচ্ছে সেটা দেখতে কৌতূহলী হয়ে এসেছিলেন।
ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছিল। পোশাক কারখানা থেকে বাসায় ফিরছিলেন অনেক পোশাক কর্মী। তাদের পাশাপাশি ঘটনা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল আশপাশের শিশুরাও। এ সময়েই আগুন ধরে যায়।
শুরুতে বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও পরে ফায়ার সার্ভিস ও বার্ন ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসক জানান, একটা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। বাসার মালিক সেটি বাইরে রেখে গেলে সেটি ঘিরে কিছু উৎসুক লোকজন দাঁড়িয়েছিল। এ সময়েই পাশের আরেকটি বাসায় চুলা ধরাতে গেলে পুরো রাস্তায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতেই তারা সবাই দগ্ধ হয়।
ওই ঘটনায় পোশাক কারখানার শ্রমিক মো. তারেকের কোমরের নীচ থেকে দুই পা পুড়ে গেছে।
তারেক বলছেন, কারখানা থেকে ফিরে হইচই ফোনে বাইরে গিয়ে দেখেন গলির মধ্যে একটি সিলিন্ডারে ভেজা চট পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে সশব্দে গ্যাস বেরোচ্ছে। সেটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তখন সিলিন্ডারে ঘিরে বেশ কয়েকজনকে দেখতে পান তিনি।
ফেরার জন্য কয়েক কদম গিয়েছেন, সে সময় আগুন ধরে যায়। এ সময় আশপাশে যারা ছিলেন তারা মারাত্মকভাবে ঝলসে গেছেন। এলাকাটি পোশাক কর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষের বাস। অনেকটা বস্তির আদলে গায়ে গা লাগিয়ে টিনশেড ঘর বলে জানাচ্ছেন তারেক। এই ঘরগুলোতে ভাড়া থাকেন তারা।
গাজিপুর থেকে আসা মো. আকাশ খান জানান, বিকালে ওই এলাকার শফিক নামে এক ব্যক্তি রান্নার জন্য বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আসে। কিন্তু চুলার সাথে লাগানোর সময় গ্যাস লিকেজ হয়ে গ্যাস বেরুতে থাকে। তখন শফিক গ্যাস সিলিন্ডার রাস্তায় রেখে যায়। তখন এলাকার মহিলা, পুরুষ, শিশু সহ সবাই সিলিন্ডার দেখতে ভীর করে। অনেকেই বাসার গেট থেকে দেখতে থাকে। কিছুক্ষন পর সিলিন্ডারে আগুন ধরে যায়। এতে সবাই দগ্ধ হয়।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, তেলিরচালা এলাকায় শফিক খান তার বাসার জন্য একটি গ্যাস সিলিন্ডার আনেন। পরে সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে লাগানোর সময় গ্যাস বের হতে থাকে। তখন তিনি সিলিন্ডারটি বাইরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন। এ সময় ওই স্থানে একটি মাটির চুলার আগুন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাসে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। তখন রাস্তায় থাকা প্রায় ৩৬ জন অগ্নিদগ্ধ হয়।
ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়।